খুলনা | শনিবার | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৫ আশ্বিন ১৪৩০

ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৫১ এ.এম | ০৫ মে ২০২৩


চলছে মে মাস। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা নিয়ে সবাই সোচ্চার। কিন্তু মুসলমান হিসেবে আমাদের জানা দরকার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিয়, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি সার্বিক বিষয়েই মহানবী (সঃ) আমাদের আদর্শ বা মডেল। তার জীবনের সর্বত্রই রয়েছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় অনুপম আদর্শ। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং মহান আল­াহপাক পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ (সূরা আহযাব: ২১)। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা কি হবে সেটাও আল­াহ’র রসূল (সঃ) আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন। পবিত্র কোরআন-হাদিসে এ ব্যাপারে পরিস্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইসলাম সব ধরণের জায়েয কাজকেই উৎসাহিত করেছে। ইসলামে কোন কাজই হীন, তুচ্ছ বা ঘৃণার নয়। সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হুজুর (সঃ) নিজেও ছোট থেকে ছোট কাজ করেছেন। ছোট বেলায় ছাগল চরাতেন, যৌবনে ব্যবসা করেছেন। সাহাবায়েকেরাম (রাঃ) ছোট ছোট কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেননি। একারণে ইসলামের দৃষ্টিতে সবকাজই সম্মানের। ইসলাম সব ধরণের কাজকেই মর্যাদা দিতে আদেশ দিয়েছে। এক হাদিসে বিশ্বনবী (সঃ) এরশাদ করেন: কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো। তার মধ্যে একশ্রেণি হলো তারা, যারা তাদের শ্রমিকদেরকে কাজ সম্পন্ন করার পরও ন্যায্য পাওনা দেয় না (বুখারি)। আল­াহর রসূল (সঃ) এর স্পষ্ট হুকুম হলো, তোমরা শ্রমিকের মজুরি দিয়ে দাও তার গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই (ইবনে মাজাহ)। আর আমাদের মালিকরা কি করেন? ন্যায্য মজুরি পেতেও শ্রমিকদের গলদঘর্ম হতে হয়। 
সূরা আরাফে মহান আল­াহপাক মাদইয়ানবাসীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন; তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ করো এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না এবং ভ‚পৃষ্ঠে সংস্কার সাধনের পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এটা হলো তোমাদের জন্য কল্যাণকর তোমরা বিশ্বাসী হও (সূরা আরাফ:৮৫)। আর আমাদের উদ্দেশ্যে সারা জাহানের বাদশাহ মহান আল­াহতায়ালা বলেন: যারা মাপে কম করে তাদের জন্য দুর্ভোগ; যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করেনা যে, তাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে? সেই মহাদিবসে; যে দিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে (সূরা আত-তাতফীফ: ১-৬)। এই আয়াতগুলো থেকে তাফসির বিশারদগণ এই ব্যাখ্যা করেছেন যে, যারা কর্মচারি বা শ্রমিকদের কাছ থেকে কাজ বেশি নেয়, কিন্তু মজুরি দেবার সময় কম দেয় তারাও এই আয়াতে উলে­খিত ধমকির আওতায় আসবে। অর্থাৎ ওই সমস্ত মালিদেরকে আল­াহতায়ালা অত্যন্ত অপছন্দ করেন যারা তাদের অধীনস্থ কর্মচারি, শ্রমিক বা কাজের লোকদেরকে তাদের ন্যায্য মজুরি দেয় না। 
শুধু শ্রমিক নয়, আমাদের অধীনস্থ কাজের লোক, কাজের মেয়ে, কর্মচারি, খাদেম তাদের ব্যাপারেও ইসলাম আমাদের উত্তম ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছে। মহানবীর (সঃ) জীবনের শেষ কথা ছিল এরকম: নামাজ, নামাজ। আর তোমাদের অধীনস্থদের (চাকর-নকর, কর্মচারি, খাদেম, কাজের লোক ইত্যাদি) ব্যাপারে আল­াহকে ভয় করো (আবু দাউদ)। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আমি আমার ৮ বছর বয়স থেকে দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ মহানবী (সঃ)-এর খেদমত করেছি। এর মধ্যে আমি অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু দয়ার নবী কোন দিন এ কথা বলেননি, এ কাজ তুমি কেন করেছো অথবা একাজ তুমি কেন করোনি? এক ব্যক্তি আল­াহ’র রসূলের (সঃ) কাছে এসে অভিযোগ করলো, আমার খাদেম নানারকম ভুল করে। আমি তাকে কতবার মাফ করবো? দয়ার নবী (সঃ) উত্তরে বলেন, দিনে সত্তর বার। হযরত আবু মাসউদ (রাঃ) বলেন, একদা আমি আমার এক গোলামকে প্রহার করিতেছিলাম, এমন সময় আমার পিছন দিক থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, হে আবু মাসউদ! নিশ্চয়ই তার ওপর তোমার যতটুকু ক্ষমতা আছে আল­াহ তোমার ওপর তার চেয়েও অধিক ক্ষমতাবান। আমি ফিরে তাকিয়ে দেখি রসূলুল­াহ (সঃ) কথা বলছেন। বললাম, ইয়া রসূলুল­াহ (সঃ), আল­াহ’র ওয়াস্তে আমি তাকে আজাদ বা মুক্ত করে দিলাম। এতে রসূলুল­াহ (সঃ) ফরমাইলেন: যদি তুমি এটা না করতে তাহলে দোজখ তোমাকে অবশ্যই স্পর্শ করতো অথবা দোজখ তোমাকে অবশ্যই গ্রাস করতো (বুখারি: আদাবুল মুফরাদ)। 
আর এক হাদিসে মানবতার মূর্তপ্রতীক বিশ্বনবী (সঃ) আদেশ করেন: তোমাদের অধীনস্থরা তোমাদের  ভাই। আল­াহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। অতএব, যার অধীনে তার ভাই থাকবে তাকে তাই খাওয়াবে যা সে নিজে খায়; তাকে তাই পরিধান করাবে যা সে নিজে পরবে। অধীনস্থদের থেকে এমন কাজ নেবে না যা তাদের ওপর বোঝা হয়ে যায়। আর যদি এরূপ কাজ লও তবে তুমি তার কাজে সাহায্য করবে (বুখারি)। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াছির (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল­াহ (সঃ) এরশাদ করেন: যে মালিক নিজের গোলামকে অন্যায়ভাবে মারপিট করবে, কিয়ামতের দিন তার হতে বদলা নেয়া হবে (তাবারানী, মাজমায়ে যাওয়ায়েদ)। শ্রমিক বা কর্মচারিকে মারধরও করাও এই ধমকির অন্তর্র্ভুক্ত হবে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রসূলুল­াহ (সঃ) এরশাদ করেন: যখন তোমাদের মধ্যে কারও খাদেম (কাজের লোক বা কাজের মেয়ে) তার জন্য রান্নার গরম  ও ধোঁয়ার কষ্ট সহ্য করে তার জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে, তখন মালিকের উচিত সে যেন এই খাদেমকে তার সাথে খানায় বসায় এবং সেও তার সাথে খায়। যদি সেই খানা কম হয় (যা দু’জনের জন্য যথেষ্ট হয় না), তবে মালিকের উচিত যেন খানা হতে দু’এক লোকমা হলেও খাদেমকে দিয়ে দেয় (মুসলিম)। তাই আসুন আমরা শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা দিয়ে ইসলামের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত হই। 
লেখক : মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া থেকে।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ