খুলনা | শনিবার | ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ | ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

গীবত বা দোষচর্চা: এক ধ্বংসাত্মক ব্যাধি

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০২:২৩ এ.এম | ১২ মে ২০২৩


গীবত আরবি শব্দ। এর অর্থ দোষচর্চা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পেছনে সমালোচনা ইত্যাদি। গীবত এমন এক মারাত্মক ব্যাধি যা মানুষের আমলকে সমূলে বিনাশ করে দেয়। কিন্তু এই গীবতে আজ আমরা এমনভাবে নিমজ্জিত যে, আমরা নিজেরাও জানি না গীবত করে যাচ্ছি। সাধারণত অধিকাংশ মানুষ গীবতকে ঘটনার বর্ণনা বলে চালিয়ে দেয়। গীবতকে অনেকে মজা করে বলেন, ‘ঘিভাত’। অর্থাৎ ঘিভাত খেতে যেমন মজা লাগে, ঠিক তেমনি গীবত করতেও বেশ মজা লাগে। আমরা মনে করি যদি কারও জেনুইন বা প্রকৃত দোষ থাকে তা প্রকাশ করা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যদি কারও মধ্যে কোন দোষ থাকে এবং তার অগোচরে তা বলা হয়, তবেই তা গীবত হবে। সাহাবায়ে কেরাম রসূলুল­াহ সল­াল­াহু আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর! যদি সত্যিই তার মধ্যে সে দোষ থাকে যা আমরা আলোচনা করি তবে কি গীবত হবে?  নবীজি (সাঃ) বললেন, যদি সত্যই তার মধ্যে দোষটি থাকে তবে তো তা গীবত হবে। আর যদি তার মধ্যে ওই দোষ না থাকে তবে তো মিথ্যা অপবাদ বা ‘তুহমত’। তুহমত গীবত অপেক্ষা আরও মারাত্মক। সুতরাং ইসলামের পরিভাষায় গীবত হলো কোনো ব্যক্তির সত্য অপরাধ বা দোষত্র“টি তার অসাক্ষাতে আলোচনা করা যা শুনলে বা জানলে সে মনে কষ্ট পাবে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে মানুষের দোষ জনগণকে অবহিত করা যায়, যা পরবর্তি কোন এক সংখ্যায় আলোচনা করব ইনশাল­াহ। 
গীবত করা আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সামিল। পবিত্র কুরআনে আল­াহ তায়ালা বলেন: ‘তোমরা একে অন্যের গীবত করোনা; তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? তা তোমরা অপছন্দই করো (সূরা হুজুরাত:১২)’। আব্দুল­াহ  ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “একদা আমরা নবী কারীম (সাঃ)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর একজন তার সমালোচনা করল। তখন রাসূলে পাক সল­াল­াহু আলাইহিস সালাম তাকে বললেনঃ তোমার দাঁত খিলাল কর। লোকটি বললঃ কি কারণে দাঁত খিলাল করব? আমিতো কোন গোশত ভক্ষণ করিনি। তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ অর্থাৎ ‘গীবত’ করেছ।”
ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছে। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম হতে বিরত থাকতে সকলকে তাকীদ দিয়েছে। সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের প্রাসাদকে ভেঙে তছনছ করে দিতে পারে এমন বিষয়গুলির মধ্যে পরনিন্দা বা গীবত হলো অন্যতম। এর মাধ্যমে শয়তান পরিবার ও সমাজে ফাটল ধরিয়ে থাকে। ভাইয়ে ভাইয়ে দ্ব›দ্ব লাগিয়ে দেয়। গীবত কবীরা গুণাহ। গীবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদিসে গীবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহীহ আত্ তারগীব)। গীবত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণ। রসূলুল­াহ (সাঃ) বলেনঃ “মিরাজকালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা হে জিবরাঈল? তিনি বললেনঃ “এরা তারাই যারা গীবত করত এবং তাদের ইজ্জত-আবরুর বিনষ্ট করত (আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ)।” কবরে শাস্তির অন্যতম কারণ হলো গীবত। সহিহ হাদিসে আছে, একদা মহানবী সল­াল­াহু আলাইহিস সালাম দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ “এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদেরকে তেমন বড় কোন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা (যা পালন করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, গীবত করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারণে।” অন্য হাদিসে গীবতের  পরিবর্তে চুগলখোরীর কথা উলে­খ আছে। 
গীবত এক ধ্বংসাত্মক ব্যাধি যা মানুষকে জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে: ‘দুর্ভোগ (জাহান্নাম) ওই সব ব্যক্তির জন্য, যারা পশ্চাতে ও সন্মুখে সমালোচনা করে; দোষ অনুসন্ধান ও নিন্দা চর্চা করে (সূরা হুমাযাহ:১)’। আল­াহ তায়ালা আমাদের সকলকে গীবত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
লেখক: মৎস্য বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ