খুলনা | শনিবার | ১০ জুন ২০২৩ | ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

অদ্ভুত এক মানসিক রোগ-স্কিজোফ্রেনিয়া!

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট |
০২:০৯ এ.এম | ১৯ মে ২০২৩


স্কিজোফ্রেনিয়া একটি তীব্র মানসিক ব্যাধি। এ প্রকার রোগে ব্যক্তির চিন্তা, আবেগ এবং আচরণে প্রচন্ড রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ রোগে ব্যক্তির চিন্তা ধারা যৌক্তিকভাবে অসংলগ্ন হয়ে পড়ে, প্রত্যক্ষণ ও মনোযোগ ত্র“টিপূর্ণ হয়।
স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ সমূহ: স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসামূলক লক্ষণ সমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়: ধনাত্মক ও ঋণাত্মক লক্ষণ সমূহ।
ধনাত্মক লক্ষণ সমূহ: (১) অসংলগ্ন কথাবার্তা: অসংলগ্ন কথাবার্তা, ব্যক্তিগত ধারণা সমূহের মধ্যে অসঙ্গতি এবং নিরর্থক কথাবার্তা স্কিজোফ্রেনিয়ার একটি অন্যতম লক্ষণ।
(২) ভ্রান্তবিশ্বস: স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীর চিন্তা ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চিন্তার বিচ্যুতি। তাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তাদের কোন রকম অন্তদৃষ্টি থাকে না। তাদের আচরণ অদ্ভুত রকেমের-সেটা তার বুঝতে পারে না। তাদের দৃঢ় বিশ্বস পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক তাদের ঘৃণা করে, তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে, এমন কি তাদের মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করে। এরূপ রোগীদের মধ্যে ৬৫% জনের মৃত্যু সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা বিদ্যমান। 
(৩) অলীক প্রত্যক্ষণ: অলীক প্রত্যক্ষণ হলো প্রত্যক্ষণমূলক বিভ্রান্তি যখন পরিবেশের কোন সংবেদন ছাড়াই ব্যক্তি একটি সংবেদীয় অভিজ্ঞতা লাভ করে। রোগী এমন কিছু দেখে বা শোনে বাস্তবে বাইরের পরিবেশে যার কোন অস্তিত্ব নেই। গবেষণায় দেখা গেছে-স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীর বেশির ভাগই শ্রবণ সম্পর্কিত অলীক প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। অনেক রোগী শুনতে পায় যে, কতক গুলো কন্ঠস্বর তাদের সাথে তর্ক করছে, ভয় দেখাছে বা শাসাচ্ছে। কারো কারোর মনোযোগ সমস্যা দেখা দেয়। তাদের আশে পাশের ঘটনা সমূহে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়। আসলে পৃথিবীটা তাদের কাছে অন্যরকম মনে হয়।
(৪) ঋণাত্মক লক্ষণাবলী: ঋণাত্মক লক্ষণাবলী বলতে আচরণগত অভাবকে বা অক্ষমতাকে  বোঝায়। যেমন- ইচ্ছার অভাব, চিন্তার বিকৃতি, আনন্দহীনতা, আবেগ শূন্যতা ইত্যাদি। 
(ক) ইচ্ছার অভাব : রোগীর বাস্তব কাজ কর্মে আনন্দহীনতা দেখা দেয়। রুটিন মাফিক কাজ করতে ব্যর্থ হয়। ব্যক্তিগত বেশ ভূষার প্রতি নজর দেয় না, নখ কাটে না, পোশাক আলুথালু থাকে। চুল আচড়ায় না।
(খ) চিন্তার বিকৃতি: কেউ কেউ খুব কম কথা বলে, কারো কারো কথা বলার পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলেও অর্থহীন কথা বলে, পুনরাবৃত্তিমূলক হয় এবং দ্ব্যর্থবোধক হয়। 
(গ) আনন্দনুভুতির অক্ষমতা: রোগীর চিত্তবিনোদন মূলক কাজে আগ্রহের অভাব দেখা দেয়। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ হয় এমনকি যৌন ক্রিয়ায় অনীহা দেখা দেয়। 
(ঘ) আবেগের অক্ষমতা: রোগী আবেগ শূন্য হয়ে পড়ে,চোখগুলো নিষ্প্রাণ দেখায়। আইপিএস গবেষণা মতে স্কিজোফ্রেনিয়ার ৬৬% জনের মধ্যে আবেগের অক্ষমতার লক্ষণটি বিদ্যমান। 
(ঙ) সামাজিক দক্ষতার অভাব: স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীদের সামাজিক সম্পর্ক খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের বন্ধু-বান্ধব কম থাকে। সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে থাকে। 
(চ) অনুপযুক্ত ভাবাবেগ: স্কিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া অনুপযুক্ত হয়ে থাকে। মা মারার গেছে এরূপ খবর শুনে হয়তোবা তারা হাসতেও পারে। তাদের আবেগ ঘন ঘন পরিবর্তন হয়ে থাকে। অনেকের মধ্যে অদ্ভুত প্রকারের আচরণ দেখা যায়। যেমন-ছেড়া কাগজ বা ময়লা জমিয়ে রাখা, একাকি কথা বলা ইত্যাদি।
স্কিজোফ্রেনিয়া রোগীদের চিহ্নিত করতে হলে লক্ষণাবলী কমপক্ষে ছয় মাস স্থায়ী হতে হবে। ডিএসএম -৪ অনুযায়ী উক্ত ছয় মাসের মধ্যে অন্তত: এক মাস সক্রিয় অবস্থা বিদ্যমান থাকবে যখন নিচের লক্ষণ সমূহ মধ্যে কমপক্ষে দু’টি উপস্থিত থাকবে। (ক) ভ্রান্তবিশ্বস (খ) অলীক প্রত্যক্ষণ (গ) অসংলগ্ন কথাবার্তা (ঘ) প্রচন্ড বিশৃঙ্খলাপূর্ণ আচরণ এবং ঋণাত্মক লক্ষণাবলী । বাকি ৫ মাস পূর্বকালে বা অবশিষ্ট কালে ঋণাত্মক লক্ষণ সমূহ বিদ্যমান থাকবে।
স্কিজোফ্রেনিয়ার কারণ: শারীরিক কারণ (১) ডোপামিন তত্ত্ব: এ তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয় যে মস্তিষ্কের বিশেষ স্নায়ু পথে ডোপামিন নামক নিউরোট্রন্সমিটারের গ্রাহকগুলোর অতিরিক্ত সংবেদনশীলতাই কারণে স্কিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।
(খ) গ্লুটামেট তত্ত্ব: এ তত্ত্বে বিশ্বস করা হয় যে মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জুর তরল পদার্থে গ্লুটামেট নামক নিউরোট্রন্সমিটারের পরিমাণ কমে গেলে স্কিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। 
(গ) মস্তিষ্কের পার্শ্ব ভাগ ও লিমবিক তন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ততা: হিপোক্যাম্পস, এমিগডালা ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স এর স্নায়ুকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্কিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।
(২) সামাজিক কারণ: (!) পীড়ন ও স্কিজোফ্রেনিয়া:  জীবনে চাপ বা পীড়ন মাত্রা বেড়ে গেলে স্কিজোফ্রেনিয়া বৃদ্ধি ঘটে। পীড়ন দুই প্রকার হতে পারে-
(ক) সামাজিক শ্রেণি ও পীড়ন: প্রথমতঃ নিম্ন শ্রেণির মধ্যে স্কিজোফ্রেনিয়া হওয়ার প্রবণতা বেশি। সাধারণত: সমাজের অন্য ব্যক্তিদের নিকট হতে অবমাননাকর ব্যবহার, অশিক্ষা, পুরস্কারের অভাব এবং সুযোগ- সুবিধার অভাব ব্যক্তির মধ্যে পীড়নমূলক অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে যা ব্যক্তির মধ্যে স্কিজোফ্রেনিয়া বিকাশ ঘটাতে পারে। 
(খ) পরিবার ও স্কিজোফ্রেনিয়া : দ্বিতীয়ত: পরিবারের সদস্যদের সাথে শিশুর সম্পর্ক তথা (১) মায়ের সাথে সন্তানের নিরুত্তাপ ও শীতল সম্পর্ক, মা প্রাধান্য বিস্তারকারী (২) দ্ব›দ্ব সৃষ্টিকারী মা-বাবা (যে মা বাবা শিশুর মধ্যে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করেন) অনেক ক্ষেত্রে মনের অজান্তে শিশুর মধ্যে স্কিজোফ্রেনিয়ার বীজ বপন করে থাকতে পারে। 
স্কিজোফ্রেনিয়ার মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা: (১) সাইকোডাইনামিক চিকিৎসা: এ চিকিৎসা পদ্ধতিতে মনে করা হয় যে- স্কিজোফ্রেনিয়াদের ভঙ্গুর অহংসত্তা সামাজিক জীবনের কঠিন বাস্তবতা থেকে উদ্ভুত পীড়ন সমূহ মোকাবেলা করতে না পেরে শৈশবের জীবনের আচরণে প্রত্যাবর্তন করে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তিকে প্রাপ্ত বয়স্কদের উপযোগী আচারণ শিক্ষা দেওয়া হয়। জীবনের যে সব ঘটনা রোগীর এ অবস্থার জন্য দায়ী সে সম্পর্কে ব্যক্তিকে অন্তদৃষ্টি লাভে সহায়তা করা হয়। 
(২) পারিবারিক চিকিৎসা পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে পিতা -মাতাকে এমন ভাবে শিক্ষা দেওয়া যে রোগীর ধনাত্মক ও ঋণাত্মক অনুভূতি সমূহের প্রতি আঘাত না করে সম্মানের সাথে বিচার করতে বলা হয়। 
স্কিজোফ্রেনিয়া এমন একটি মানসিক ব্যাধি যেখানে ব্যক্তির সব ধরণের বৌদ্বিক ক্রিয়ায় অবনতি লক্ষ্য করা যায়। তাই এরুপ রোগীদের পারিবারিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশের তত্ত¡াবধানে নিজেদের মত আপন মনে করে এক জন বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর চিকিৎসা দ্বারা রোগের জটিল বুনন থেকে সহনীয় পর্যায়ে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
(লেখক: প্রফেশনাল সাইকোলজিস্ট, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ,খুলনা, ফ্রি পরামর্শ: ০১৭১৪৬১৬০০১)।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ