খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

কচুয়ার জীবন সংগ্রামে জয়ী পাঁচ নারীকে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা প্রদান

কচুয়া প্রতিনিধি |
১১:১৯ পি.এম | ০৯ জুন ২০২৩


বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার জীবনযুদ্ধে জয়ী পাঁচ সংগ্রামী নারীকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা দিয়েছে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। সমাজের নানা প্রতিকূলতা ও নির্যাতন পেরিয়ে তারা সফলতা অর্জন করেছেন। জীবনসংগ্রামে সফল হওয়া এসকল নারীকে সরকার জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কর্মসূচির আওতায় সম্মানজনক এই পদক দেয়। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ হাফিজুর রহমান বৃহস্পতিবার জানান,  তাদের সংগ্রামী জীবন কাহিনী অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী ও শিক্ষণীয়। পাঁচজন নারীর সংক্ষিপ্ত জীবন সংগ্রাম নিম্নে তুলে ধরা হলো।  
অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী: কচুয়া উপজেলা সদরের মোঃ ইয়াছিন আরাফাতের স্ত্রী আমিনা আক্তার মিনার ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। তখন তার স্বামী বেকার। বিয়ের কিছুদিন পর সংসারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। মিনা তখন দর্জির কাজ ও বাড়ি বাড়ি ঘুরে শিশুদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। লোক নিন্দায় শাশুড়ি তাতে নিষেধ করেন। পরে নিজের গহনা বিক্রি করে কম্পিউটার কিনে কম্পোজের কাজ করেন। তার আয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। একপর্যায়ে সে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে কাজ শিখে বাড়ি ফিরে একটি দোকান দেন। ২০১২ সালে স্বামীর দুর্ঘটনায় ব্যবসাটি বন্ধ হয়। কিছুদিন পর হাঁস-মুরগী ও কোয়েল পাখি পালন ব্যবসা শুরু করেন। তাতেও বাঁধা আসে। এরপর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আইজিএ প্রশিক্ষণে ব্লক-বাটিকের কাজ শিখে ব্যবসা শুরু করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়ে নিজের জমিতে বসতবাড়ী করেন। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জন করায় আমিনা আক্তারকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক প্রদান করেছে।
শিক্ষা ও চাকুরি ক্ষেত্রে সফল নারী: দরিদ্রতা কচুয়ার টেংরাখালী ইউনিয়নের টেংরাখালী গ্রামের শিকদার মোঃ মাসুমের স্ত্রী আনজুমানারা খাতুনের লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছাকে ঠেকাতে পারেনি। আনজুমানারা খাতুন জানান, এইচএসসি পাশের পর দরিদ্র মা-বাবা তাকে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর পরিবারেও আর্থিক অনটন দেখা দেয়। এই অভাব মেটাতে তিনি দর্জি কাজ, প্রাইভেট পড়ানো, প্রাইভেট স্কুলে কাজ করেন। পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যান। সমাজের নানা বাঁধা পেরিয়ে তিনি বিএ পাশ করেন। এরপর আন্ধারমানিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সংসারের হাল ধরে যখন সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, তখন তার স্বামী এবং সন্তানের কিডনী রোগ ধরা পড়ে। এদিকে নিজেও হার্টের রোগী। তবুও তিনি জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে সফল নারী হওয়ায় তার সংগ্রামী জীবনকে সম্মান জানাতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাঁকে সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক প্রদান করেছে। এই সম্মাননা পেয়ে তিনি বলেন, ‘নবজীবন পেলাম। সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’ 
সফল জননী: কল্পনা রানী বসু স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি দুই সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। তবু মনোবল হারাননি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করেছেন। এজন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর তাঁকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ প্রদান করেছে। তিনি কচুয়া সদর উপজেলার প্রয়াত দেবু প্রসাদ বসুর স্ত্রী। কল্পনা জানান, তাদের নিজস্ব তেমন কোন জায়গা-জমি ছিল না। বিবাহিত জীবনে ১৬ বছর পর স্বামীর মৃত্যুতে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। দুই সন্তানকে লেখাপড়া শেখানো ও প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সীমাহীন পরিশ্রম করেন। এখন তার মেয়ে তপা বসু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এবং বর্তমানে সাব-রেজিষ্ট্রার হিসেবে কচুয়া উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। ছেলে পল­ব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাষ্টার্স এবং বিসিএস ৪০তম ব্যাচ (শিক্ষা ক্যাডার)।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরুকারী নারী : নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেন আজিজুন নেছা। তিনি কচুয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মৃত শেখ মোজাহারুল ইসলাম ও কামরুন্নেছা বেগমের মেয়ে। আজিজুন নেছা জানান, এসএসসিতে লেখাপড়াকালে তার বিয়ে হয়। প্রথম সন্তান গর্ভে আসলে স্বামী তাকে গোপনে গর্ভপাত করান। এরপরে আর সন্তান না হওয়ায় স্বামী, ননদ ও শ্বশুর-শাশুরীর অত্যাচার শুরু করে। তার স্বামী পরনারী আসক্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে একটি কন্যা সন্তান হয়। স্বামীর পরনারী আসক্তির ব্যাপারে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বারদের কাছে নালিশ জানিয়ে বিপদ বেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে স্বামীর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ি চলে আসেন। একটি কসমেটিকস দোকান দেন। তাই দিয়ে মেয়ের পড়ালেখাসহ সকল চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে ভাল আছেন। তার মেয়ে ঢাকা ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অনার্স পড়ছে। এমন সাহসী জীবন সংগ্রামের জন্য মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি তাকে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা-২০২২ পদক দিয়েছে। 
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদানকারী নারী: কচুয়া উপজেলার মসনী গ্রামের গোপীনাথ দাসের স্ত্রী বনলতা রানী দাস ১৫ টির বেশি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করেছেন। কচুয়া উপজেলার বাধাল ইউনিয়নে তিনি একাধিকবার মহিলা ইউপি সদস্য। এছাড়াও তিনি বাধাল ইউনিয়নের মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। এলাকার গর্ভবতী মায়েদের সেবাদান, গরিব অসহায় মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তি দেয়া, কর্মঠ নারীদের হাঁস-মুরগী প্রতিপালনের মাধ্যমে সাবলম্বীর ব্যবস্থা করাসহ নানাভাবে সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন। ব্র্যাকের মাধ্যমে নারীদের আইনগত সহায়তা দেন। সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখায় তাঁকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সম্প্রতি শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা- ২০২২ পদক দিয়েছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ