খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু আচরণ বদলেছে এডিস মশার

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:১১ এ.এম | ০৭ জুলাই ২০২৩


রাজধানী ঢাকার বাইরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু রোগী। সেই সঙ্গে বদলেছে এডিস মশার আচরণ। পুরো বর্ষা মৌসুম ভোগাতে পারে এডিস মশাবাহী এই সংক্রমণ। প্রতিদিন ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিচ্ছে। তবে রাজধানী ঢাকার পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামে।
২৪ ঘণ্টায় ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৬৬১ জন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বৃহস্পতিবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বুধবার সকাল ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৬৬১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩৩ জন, আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৮ জন। এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ২০১৯ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১৪৯০ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৩৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। 
চট্টগ্রামের মেয়রকে সিভিল সার্জনের চিঠি : ডেঙ্গু পরিস্থিতি গত বছরের চেয়ে আশঙ্কাজনক উলে­খ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। 
বৃহস্পতিবার মেয়রকে জরুরি চিঠি দিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলে ধরেন সিভিল সার্জন। একই ভাবে রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককেও (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, গত ৫ দিনে চট্টগ্রামে ১৯৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও মশকনিধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
এদিকে ২৪ ঘণ্টায় ৫৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, চলতি বছর এক দিনে এত জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার তথ্য নেই।
এ বছর এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৫৫৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। শুধু জুনেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছেন ৩১৮ জন। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে ১০ জন মারা গেছেন।
খুমেকে ভর্তি ১৯ জন: খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, খুলনাতেও সনাক্ত হচ্ছে ডেঙ্গু রোগী। ২৪ ঘণ্টায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ৪ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে এবং ২ জন সুস্থতা হয়ে ছাড়পত্র নিয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ৫৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তবে খুলনাতে কোনো মৃত্যু নেই।
বাগেরহাটে আক্রান্ত ১৫ : বাগেরহাটে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।
গত বুধবার (৫ জুলাই) বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে তিনজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। অবশিষ্টদের মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়েছেন আর বাকিরা নিজ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শনাক্ত হওয়া রোগীরা বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে জেলা হাসপাতাল ব্যতীত উপজেলা হাসপাতাল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কোনো রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
বাগেরহাট জেলা হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডাঃ অসিম কুমার সমাদ্দার বলেন, বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে প্রায়ই ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গেল দুই সপ্তাহে ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। 
বরিশাল বিভাগে ভর্তি ৭০ জন : বরিশাল বিভাগে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৯ জন এবং পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
এছাড়াও বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে ৯ জন, পিরোজপুরে ৯ জন, বরগুনায় ১০ জন এবং ভোলায় ৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ১৫৪ জন রোগী ভর্তি আছেন। ১ জানুয়ারি থেকে হাসপাতালে ৭৮২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন ৬২৭ জন। শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুও হয়েছে।
রামেক হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশের বাইরে ভ্রমণের রেকর্ড পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে-তারা ভ্রমণের সময়েই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জরুরি অবস্থা তৈরি হয়নি। তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে হাসপাতালে ১১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। গত বুধবার রোগী ছিল ৯ জন। এর মধ্যে বাঘার পাপ্পু (৪০) নামে এক ব্যক্তি আইসিইউতে আছেন। আক্রান্তদের মধ্যে তিনজন নারী-শিশু ও আটজন পুরুষ রয়েছেন। আক্রান্তদের সবাই ঢাকা থেকে রাজশাহীতে এসেছেন।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহম্মদ জানান, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের অধিকাংশই ঢাকা ফেরত। ধারণা করা হচ্ছে- তারা ডেঙ্গুর জীবাণু নিয়েই ঈদ করতে এসেছিলেন। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ টিম করা হয়েছে। আক্রান্তদের একজন আইসিইউতে আছেন। এছাড়া বাকিরা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে ।
বদলে গেছে এডিস মশার আচরণ : ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলো এডিস ইজিপ্টাই জাতের মশা। ভাইরাসবাহী মশার কামড়ে ডেঙ্গুর জীবাণু একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এই মশা কখন কামড়ায় এ নিয়ে অনেকেরই নানা মত আছে।
এতদিন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল এই মশাটি মূলতঃ দিনের বেলা কামড়ায়। সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায়ও দিনের বেলা মশারির ভেতরে থাকতে অথবা ফুলহাতা কাপড় পড়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
কিন্তু সা¤প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই মশাটি শুধু দিনে নয় বরং রাতেও কামড়ায়। এর অর্থ মশাটির আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এডিস মশা মানুষকে কেবল দিনের বেলায় কামড়ায় কিনা এমন ধারণা যাচাই করতে গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা পরিচালনার কথা জানান কীটতত্ত¡বিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
এটি পরীক্ষার জন্য তিনি একজন মানুষকে মশারির ভিতরে রাখেন, তখন বাইরে তাকে কামড়াতে আসা মশাগুলোকে জীবিত ধরে ধরে একটি কাপে সংগ্রহ করা হয়।
তারপর সেই মশাগুলোকে পরীক্ষাগারে এনে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে মাইক্রোস্কোপের নীচে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে এগুলো কোন প্রজাতির মশা। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মৌসুমে টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে এই মশা সংগ্রহ ও আচরণ পরীক্ষার কাজ করেছেন তিনি।
তারা মূলতঃ দেখতে চেয়েছিলেন কোন ধরণের মশা কোন সময়ে কামড়াতে বেশি পছন্দ করে। পরীক্ষায় তারা এসব মশার কামড়ানোর ছন্দ, কামড়ানোর সময় বা কর্মকান্ডের ধরণ এক এক রকম দেখেন।
এই পরীক্ষা করতে গিয়েই বাশার জানতে পেরেছেন যে, এডিস মশা দিনের বেলা যেভাবে কামড়ায়, তেমনি রাতেও কামড়ায়। তবে রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে বলে তিন জানান।
স¤প্রতি তিনি রাতের বেলায় তার শরীরে বসা মশার প্রজাতি পরীক্ষা করে এডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছেন। এতে তিনি ধারণা করছেন, একসময়ে এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ালেও এখন এই মশার বৈশিষ্ট্যে বা আচরণগত পরিবর্তন এসেছে।
বাশার জানান, এডিস মশার রাতেও সক্রিয় থাকার কারণ হিসেবে রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহারকে একটি বড় কারণ হিসেবে উলে­খ করা হচ্ছে। শহরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে।
অতিরিক্ত আলোর কারণে একে তো মশা দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারছে না। তার ওপর এখন তারা রাতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথেও খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
সাধারণত সারাদেশে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এডিস মশার লার্ভা সৃষ্টি হয়। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব কয়েক গুণ বেড়েছে সময়ের আগেই। এতে শঙ্কিত কীটতত্ত¡বিদরা।
এডিস মশার এই আচরণগত পরিবর্তনের কারণেই এটি সুপার পতঙ্গ এবং আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

্রিন্ট

আরও সংবদ