খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

জনবল সংকট, রোগীর চাপে স্বাস্থ্য সেবা ভেঙে পড়ছে

ধারণ ক্ষমতার তিনগুণের বেশি রোগী খুমেক হাসপাতালে

বশির হোসেন |
০১:০৪ এ.এম | ১৯ জুলাই ২০২৩


ধারণ ক্ষমতার তিনগুণের বেশি ভর্তি রোগী নিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের বারান্দা, কোরিডোর বা সিড়ি কোথাও তিল ধারণের ঠাই নেই। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। জনবল সংকটে থাকা হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। খুলনায় অন্য দু’টি সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে জটিলতা থাকায় এ অচলাবস্থার সৃষ্টি বলে জানাগেছে। 
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫০০। তবে হাসপাতালে প্রতিদিনই ভর্তি রোগী থাকছে প্রায় তিন গুণের বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় কম শয্যা থাকলেও রোগীদের বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে এ হাসপাতালকে। চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি ও জনবল সংকটও প্রকট। ফলে রোগীদের পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে। 
সড়ক দুর্ঘনায় মাথায় আঘাত নিয়ে এক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি থেকেও এখনও বেড মেলেনি কোন আবু বক্করের। আবু বক্করের স্ত্রী মুনসুর বলেন, মাথায় আঘাত নিয়ে এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালের বারান্দায় আছি ডাক্তাররা একবার এসে দেখে যায় বলেছে অপারেশন করতে হবে। কবে অপারেশন করার কথা বলেছে জানতে চাইলে বলেছে আগামী দুই মাসের মধ্যে হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তাহলে কি আমি এই দুই মাসের বেশি এই বারান্দায় পড়ে থাকবো। ততদিন আমার রোগীর কি হবে। 
সরেজমিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় প্রায় প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে নির্ধারিত ৪০ বেডের বিপরীতে ২ শতাধিক রোগী ভর্তি আছে। হাসপাতালের নিচতলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত ওয়ার্ড, ওয়ার্ডের বারান্দা, বাথরুমের পাশে, এমন কি প্রশাসনিক ব্লকের পরিচালকের কার্যালয়ের মেঝেতেও মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছে শত শত রোগী। 
মেডিসিন এর ৫টি ইউনিট রয়েছে এর মধ্যে ইউনিট ২ এ সরেজমিন দেখা যায় এই ইউনিটে বেড ৪০টি তবে রোগী ভর্তি আছে ২৬৫ জন। তবে এত সংখ্যক রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম এখান থেকে নামমাত্র কিছু দেয়া হলেও বেশির ভাগই বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। 
পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৫ দিন যথাক্রমে ১৫৩০, ১৫৩৩, ১৬০৬, ১৩০, ১৬৫৬ জন রোগী ভর্তি আছে। 
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার রোগীদের চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ফলে এখানে রোগীর চাপ বেশি। 
সূত্রটি আরও জানায়, হাসপাতালে চিকিৎসকের ২৮৮টি পদের মধ্যে ৮১টি শূন্য রয়েছে। আটটি পদের বিপরীতে পাঁচ জন সিনিয়র কনসালটেন্ট, ৪৪টি পদের বিপরীতে ৩১ জন রেজিস্ট্রার এবং ৯১টি পদের বিপরীতে ৬৩ জন ডেপুটি রেজিস্ট্রার রয়েছেন। 
সূত্রটি জানায়, হাসপাতালে এখন ৫৫টি পদের বিপরীতে ৪৩ জন ইনডোর কর্মকর্তা, ৩৬টি পদের বিপরীতে ২৯ জন আউটডোর কর্মকর্তা এবং ছয়টি পদের বিপরীতে চারজন জরুরি কর্মকর্তা রয়েছেন। বর্তমানে এখানে ১৬টি বিভাগের অধীনে ৩১টি ওয়ার্ডে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। সব থেকে বড় সংকট এ্যানেসথেসিয়া বিভাগে। এই বিভাগে ৩৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন পাঁচজন চিকিৎসক। হাসপাতালে ১০টি পদের বিপরীতে দু’জন ওটি এ্যানেস্থেসিওলজিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। ছয়টি পদ থাকা সত্তে¡ও হাসপাতালে নেই কোনো আইসিইউ এ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। ফলে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে অন্তত ৫ শতাধিক রোগী কোন না কোন রোগ নিয়ে অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। 
বহির্বিভাগেও একই চিত্র: কিছুদিন আগেও বহির্বিভাগে ৭ থেকে ৮শ’ রোগী চিকিৎসা নিলেও এখন গড়ে ১৫শ’ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। এই অধিক সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষার ৩০ শতাংশ সক্ষমতা নেই হাসপাতালটির ফলে বাধ্য হলে বেশিরভাগ রোগী বাইরে দালালের মাধ্যমে মানহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে বাধ্য হন। চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতালে ফিতে ওষুধও ঠিকমত পায়  না রোগীরা। 
সংকট কোথায় : খোজ নিয়ে জানা যায়, খুলনায় আরও দু’টি বড় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে একটি শহিদ আবু নাসের বিশেষাযিত হাসপাতাল ও অপরটি খুলনা জেনারেল হাসপাতাল। ২৫০ সয্যার হাসপাতাল দু’টিতে রোগী ভর্তি আছে ২০০ এর কম সব সময়। 
শহিদ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল বিধায় বেডের বাইরে তাদের রোগী ভর্তি করা হয় না। তবে আবু নাসের যে সকল রোগীর চিকিৎসা দেয় একই বিষয়েও খুলনা মেডিকেললে ধারণ ক্ষমতার চারগুণ রোগী ভর্তি রয়েছে। ফলে বেড খালি থাকলেও এসব রোগী নানান জটিলতায় আবু নাসেরে ভর্তি হতে না পেরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় ধুকছে। আর খুলনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসরা গড়পড়তা চিকিৎসা দিয়ে সব রোগীকে ঠেলে খুমেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ফলে ২৫০ বেডের হাসপাতালটিতে রোগী ভর্তি আছে মাত্র ১৪০ জন। 
খুমেক হাসপাতালের রেডিওথেরাপি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মুকিতুল হুদা বলেন, ‘ক্যান্সার রোগীরা তিন ধরনের চিকিৎসা পান-কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং সার্জারি। হাসপাতালে রোগীরা কেমোথেরাপি ও সার্জারি করতে পারেন। আমরা রেডিওথেরাপি দিতে পারি না। রেডিওথেরাপির জন্য একটি মেশিন দেয়া হয় কিন্তু জায়গার অভাবে সেটিকে বাক্সের বাইরেও আনতে পারিনি। ফলে যেসব রোগীদের রেডিওথেরাপির প্রয়োজন তাদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে।’
খুমেক হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ রবিউল হাসান বলেন, ‘হাসপাতালে মাত্র ৫০০ শয্যা আছে। কিন্তু এখানে প্রায় দেড় হাজার রোগী ভর্তি আছেন। ফলে হাসপাতালের বারান্দাসহ কোথাও জায়গা খালি নেই। এতো বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই।’ এই মুহূর্তে হাসপাতালটিকে ১৫০ বেড ঘোষণা দেয়া উচিত এবং সেই অনুযায়ী সকল সুযোগ সুবিধা দেয়া উচিত।
তবে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। ভবনটি তৈরি হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত জনবল ও যন্ত্রপাতি দেবে। হাসপাতালের রোগীদের তখন ঢাকায় পাঠানো হবে না।

্রিন্ট

আরও সংবদ