খুলনা | রবিবার | ১১ মে ২০২৫ | ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

আশুরার শিক্ষা, করণীয় ও বর্জনীয়

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী |
০১:৫০ এ.এম | ২৯ জুলাই ২০২৩


আরবি ভাষায় আ’শারা অর্থ দশ। এ কারণে আরবি বর্ষের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ আশুরা নামে পরিচিত। আগামী ২৯ জুলাই শনিবার  সারা দেশে পালিত হবে পবিত্র আশুরা। আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হবার কারণে মুসলিম বিশ্বে আশুরার ব্যাপক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। এই দিনে বনী ইসরাইলের জন্য সমুদ্রের মধ্য দিয়ে রাস্তা করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আবার এই একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন (বুখারী ১/৪৮১)। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’- অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের মধ্যে একটি। এ মাসে রোযা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আকুরার রোযার মাধ্যমে পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ মাফ হয়ে যায় বলে হাদিসে উলে­খ আছে। 
শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য জাতি যেমন ইয়াহুদী সম্প্রদায়েরর কাছেও মুহররম ও আশুরার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তৎকালীন আরব সমাজে আশুরার গুরুত্ব এতো বেশী ছিল যে, এই দিন পবিত্র কাবা শরীফে গিলাফ পরানো হতো। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রমযানের রোযা  ফরয হওয়ার পূর্বে মুসলিমগণ আশুরা রোযা পালন করতেন। সে দিনই কাবাঘর গিলাফে আবৃত করা হতো। নবী (সঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) যমানায় মদিনাতে অনেক ইয়াহুদী বাস করতো। তাদের কাছে আশুরার দিনটি ছিল ঈদের মতো। কারণ, এই দিন মুসা (আঃ) ও তার অনুসারী বনী ইসরাঈলকে মহান আল­াহ তায়ালা ফেরআউনের কবল থেকে বাঁচিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে সদলবলে পানিতে নিমজ্জিত করে ধ্বংস করেছিলেন। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন যে, ইয়াহুদীগণ আশুরার দিনে রোযা পালন করে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি ব্যাপার তোমরা এ দিনে রোযা পালন কর কেন? তারা বলল, এ অতি উত্তম দিন, এ দিনে আল­াহ তা’আলা বনী ইসরাঈলকে তাদের শত্র“র কবল হতে নাজাত দান করেন, ফলে এ দিনে মূসা (আঃ) রোযা পালন করেন। রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বললেনঃ আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী, এরপর তিনি এ দিনে রোযা পালন করেন এবং রোযা পালনের নির্দেশ দেন (বুখারী:১৮৭৮)। আর এক হাদিসে আবূ মূসা (রাঃ) বলেন, ইয়াহুদী স¤প্রদায় আশুরার দিবসের সম্মান প্রদর্শন করত এবং তারা এ দিনকে ঈদ বলে গণ্য করত। অতঃপর রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বললেন, তোমরাও এ দিনে রোযা পালন কর (মুসলিম:২৫৩১)।
রমযান মাসের রোযার পর সর্বোত্তম রোযা হলো আশুরার রোযা। আবদুল­াহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­ামকে রমযান ও আশুরার যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি (বুখারী ১/২১৮)। 
যেহেতু ইয়াহুদীরা শুধুমাত্র এক দিন অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখে রোযা রাখতো, সেকারণে মাত্র এক দিন রোযা না রেখে ন্যূনতম দুই দিন রোযা রাখা উত্তম বলে হাদিসে উলে­খ আছে। সে কারণে ১০ মহররমের সাথে আগে বা পিছে এক দিন মিলিয়ে মোট দুই দিন রোযা রাখতে হবে। আশুরার রোযা সম্পর্কে হাদীসে আছে যে, তোমরা আশুরার রোযা রাখ এবং ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করো; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোযা রাখ (মুসনাদে আহমদ ১/২৪১)। আবদুল­াহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আর একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম যখন আশুরার দিন রোযা পালন করেন এবং লোকদেরকে রোযা পালনের নির্দেশ দেন তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলুল­াহ! ইয়াহুদী এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম বললেন, ইনশাআল­াহ আগামী বছর আমরা নবম তারিখেও রোযা পালন করব। বর্ণনাকারী বলেন, এখনো আগামী বছর আসেনি, এমতাবস্থায় রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম এর ইন্তেকাল হয়ে যায় (মুসলিম:২৫৩৭)। 
এ কথা সত্য যে, আশুরার দিনে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন ইউসুফ (আঃ) জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন; ইয়াকুব (আঃ) চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন; ইউনুস (আঃ) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন; ইদরীস (আঃ) কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আবার এটাও প্রচলিত আছে যে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথা কুরআন-হাদিসে উলে­খ নেই বিধায় তার কোনো ভিত্তি নেই।
এ মাসের আর একটি ঘটনা হল হুসাইন (রা)-এর শাহাদত। এটা উম্মতের জন্য নিঃসন্দেহে বড় একটি শোকের বিষয়। তবে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, নবী রাসূলুল­াহ সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়াসাল­াম এরশাদ করেছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে। সুতরাং, আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিৎ যে, আমাদের মুখ থেকে এমন কোন কথা বের না হয় যাতে মহান আল­াহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন। হুসাইন (রাঃ)-এর শাহাদতকে কেন্দ্র করে কোনো ধরণের অনৈসলামিক কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরণের জাহেলী রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য। আশুরা ও মহররম কেন্দ্রিক যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে; শোক পালন, শোক মাতম, শোকগাঁথা পাঠ, শোক মিছিল ও জমকালো র‌্যালি, তাজিয়া, শোকে জামা-কাপড় ছিঁড়া, বুক চাপড়ানো, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি। এগুলো সবই কু-প্রথা। অনেকে আবার এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করেন এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ মাসে করতে চান না। যেমন অনেক মুসলমান এ মাসে বিয়ে-শাদী থেকেও বিরত থাকেন। এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে আশুরার রোযা রাখা সুন্নত । তাই আসুন, আমরা সব ধরণের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে সুন্নত-মোতাবেক আমল করি। 
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, সিডনি থেকে)

্রিন্ট