খুলনা | মঙ্গলবার | ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

মেহমানের জন্য মেজবানের করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:৪৬ এ.এম | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩


কারও বাড়িতে যখন কেউ বেড়াতে আসে তখন তাকে বলা হয় মেহমান। অপরদিকে, বাড়ির অধিবাসীদের বলা হয় মেজবান। মেহমানদারি মুসলিমের একটি বিশেষ গুণ। যা মানুষে-মানুষে বন্ধন দৃঢ় করে। সম্পর্কের গুরুত্ব বাড়ায়। পরস্পরের মধ্যে সৃষ্টি করে সৌহার্দ্য। এটি সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। যাতে আছে আনন্দ ও পূণ্য। যা কল্যাণ ও মহত্তে¡র পরিচায়ক।
এক হাদীসে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন, নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে। (বুখারী)
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে মেহমানদারি করে না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। (মুসনাদে আহমাদ) 
হযরতে উলামায়ে কেরাম মেহমানর জন্য মেজবানের কিছু করণীয় বর্ণনা করেছেন, আমরা তা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ্।
১. মেহমানের খাতিরে ভাল পোষাক-পরিচ্ছেদ পরে সুন্দর বেশভূষা অবলম্বনের চেষ্টা করা। তবে অতিরঞ্জন না হয় সেটাও লক্ষণীয়। 
২. মেহমান এলে খুব দ্রুত তাঁকে স্বাগত জানানো।
৩. মেহমান আসার সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে আন্তরিকতার সাথে মুসাফাহা করা।
৪. মেহমানের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করা।
৫. মেহমানের তাযীম করা।
৬. মেহমান আলেম হলে তাঁকে অত্যাধিক সম্মান করা। 
৭. মেহমানের আগমনে বিরক্ত না হওয়া। 
৮. মেহমান আসার পরপরই মেহমানের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা।
৯. ঘরের মানুষের আওয়াজ ও শব্দের কারণে মেহমানের নিদ্রা ও বিশ্রামের যেন ব্যঘাত না ঘটে সেদিকে পূর্ণ লক্ষ্য রাখা। 
১০. নামাযের সময় হলে কেবলার দিক জানিয়ে দেয়া। তদ্রুপ অযুর জায়গা চিনিয়ে দেয়া। 
১১. অযুর পর হাত-মুখ মোছার জন্য মেহমানকে নিজেদের ব্যবহৃত গামছা বা তোয়ালে না দেয়া। বরং তার জন্য আলাদা পরিচ্ছন্ন তোয়ালের ব্যবস্থা করা। 
১২. মেহমানের জন্য যে গোসল খানার ব্যবস্থা করা হবে সেখানে যেন এমন কোনো কাপড়-চোপড় না থাকে যা দৃষ্টিকটু। 
১৩. মেহমান যেই হোক পূর্ণ যতœ ও রুচিশীলতার সাথে মেহমানদারি কাম্য। 
১৪. মেহমানের ব্যক্তিত্ব, অবস্থা, পরিবেশ ও স্থান কাল বুঝে তার সাথে কিছু সরস কথাবার্তা বলা।
১৫. মেহমানের সামনে সহাস্যবদনে থাকার চেষ্টা করা। 
১৬. মেহমানের উপস্থিতিতে নিজের কপালকে দোষারোপ না করা।
১৭. কারো কোনো অসংলগ্ন কথা, কাজ কিংবা অন্য কোনো কারণে মেহমানের সামনেই তার উপর রেগে যাওয়া উচিত নয়। হাঁ, তখনই বলা আবশ্যক হলে আড়ালে গিয়ে বলবে। 
১৮. পর্দানশীল মহিলাদের পর্দার সাথে থাকার ব্যবস্থা করা।
১৯. মেহমানকে প্রাথমিক অবস্থায় একা রাখবে না। মেহমানকে সাধ্য অনুযায়ী সময় দেওয়া, কুশলাদি সম্পর্কে জানা, প্রয়োজনীয় কথা-বার্তা বলা। 
২০. মেজবান নিজেই মেহমানের আপ্যায়ন করা। 
২১. মেহমান আসার পর দ্রুত মেহমানদারির ব্যবস্থা করা।
২২. আপ্যায়নের জন্য উপস্থিত যা থাকবে তার মধ্যে উত্তম ও উৎকৃষ্ট খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করা।
২৩. মেহমানের সামনে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার পরিবেশন করা। 
২৪. মেহমানকে যেখানে বসানো হয়েছে সম্ভব হলে খাবার সেখানেই পেশ করার চেষ্টা করা। 
২৫. মেহমানকে খাবার শুরু করার আবেদন করতে গিয়ে আদেশ বাচক শব্দ ব্যবহার না করা। কোমল, মার্জিত ও নম্র ভাষা ব্যবহার করা। 
২৬. খাবার বা নাস্তা দিব কি না- এমন প্রশ্ন না করা। 
২৭. খাবার পরিবেশনের পর মেহমান খাচ্ছেন কি না- সেদিক লক্ষ্য রাখা। তবে তী² দৃষ্টিতে মেহমানের মুখ ও পাতের দিকে তাকিয়ে থাকবে না, এতে তার অস্বস্তি বোধ হতে পারে। বরং উড়াল দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখবে। এমনিভাবে খাওয়ার সময় কোন্ মেহমানের কী দরকার- সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা কর্তব্য।
২৮. একাধিক মেহমানকে দাওয়াত দেওয়া হলে খাবারের সময় যদি দু’একজন অনুপস্থিত থাকে তাহলে তাদের জন্য এত বেশি অপেক্ষা না করা, যা উপস্থিত মেহমানদের জন্য বিরক্তিকর ও অসহনীয় হয়ে পড়ে।
২৯. মেহমান একাধিক হলে যিনি বয়স, ইলম বা মর্যাদায় বড় তার থেকে পরিবেশন শুরু করা। 
৩০. সকল মেহমানের সাথে সমতা রক্ষা করা। বৈষম্যমূলক আচরণ না করা। 
৩১. মেহমানের সাথে দস্তরখানে অংশগ্রহণের চেষ্টা করা। তবে কোনো কারণবশতঃ না পারলে দোষ নেই।
৩২. একসাথে খেতে বসলে মেহমানের আগেই খাওয়া শেষ করে চলে যাবে না। কারণ, এতে মেহমান পেট ভরে খেতে সংকোচ বোধ করবে। এ জন্য তার সাথে শরীক থাকবে বা বসে গল্প করবে।
৩৩. গৃহকর্তা খাওয়ার পূর্বে সর্বপ্রথম নিজে হাত ধৌত করবে এবং খাওয়ার শেষে সকলের পরে হাত ধোবে।
৩৪. দস্তরখানে খাবার পরিবেশন করতে কার্পণ্য করবে না। কোনো খাবারকে গোপন করবে না। সব খাবারই মেহমানের সামনে তুলে ধরবে। 
৩৫. একই প্লেটে একাধিক মেহমানকে খেতে দিলে মেহমানের রুচির দিকে খেয়াল করা। কারণ কারো কারো এক সাথে একই প্লেটে খাওয়াতে রুচির অসুবিধা থাকতে পারে এজন্য আগে থেকেই বলে নেওয়া। কারো অসুবিধা থাকলে তার জন্য আলাদা প্লেটের ব্যবস্থা করা।
৩৬. কোনো লৌকিকতা প্রদর্শন না করা। আপ্যায়নের ক্ষেত্রে বাহুল্য না করে সামর্থ্যর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণভাবে মেহমানের সমাদর করা।
৩৭. মেহমান ‘খাবো না’ বললে সাথে সাথে খাবার তুলে না নেয়া, এতে আন্তরিকতার ঘাটতি বোঝায়। 
৩৮. খানার দস্তরখানে তরকারির প্রয়োজন হলে মেহমানের সামনে থেকে তরকারির বরতন উঠিয়ে না নেওয়া; অন্য বরতনে করে নিয়ে আসা।
৩৯. মেহমানকে খেতে দিয়ে ছোট বাচ্চাদের পাশে না রাখা বা তাদেরকে মেহমানের কাছে যেতে না দেওয়া; তবে হ্যাঁ মেহমান তাদের আদর করে কাছে নিলে অসুবিধা নেই। 
৪০. মেহমানের সামনে খাবার জিনিস ঢেকে উপস্থাপন করা। পঁচা, বাসি খাবার মেহমানকে না দেওয়া।
৪১. খাবারের পর্ব পরিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ার আগেই দস্তরখানা না উঠানো। 
৪২. ঘুমের প্রয়োজন হলে বা রাতে ঘুমানোর জন্য যেতে হলে মেহমানের অনুমতি নিয়ে ঘুমাতে যাওয়া।
৪৩. মেহমানকে কষ্টের মধ্যে না ফেলা।
৪৪. সম্ভব হলে মেহমানকে ‘জাইযা’ দেয়া। ‘জাইযা’ হল এক দিন ও এক রাতের সম্বল সাথে দিয়ে দেয়া।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে মেহমানদারির উসূল ও আদবের দিকে লক্ষ্য রেখে মেহমানের হক আদায় করার ওফিক দান করুন। আমীন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সংকলক: লেখক ও গবেষক।

প্রিন্ট

আরও সংবাদ