খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৭ কার্তিক ১৪৩১

‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের সুর বিকৃতি এ সাহস পেলো কোথায়?

এড. এম মাফতুন আহমেদ |
০১:২৮ এ.এম | ২৬ নভেম্বর ২০২৩


যুগে যুগে ধরণীর বুকে কিছু অতি মানবের আগমন ঘটে। তাই তাঁদের বলা হয় যুগ শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতির মহীরুহ। তাঁরা দিশাহীন জাতিকে আলোর দিশা দেখান। ছড়িয়ে দেন দেশ থেকে দেশান্তরে একরাশ আলোকরশ্মি। তাঁদের মধ্যে অনন্য বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী হলেন যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মহান সাধক বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। 
তিনি রণবীর। জাতীয় বীর। জাতীয় কবি। বিদ্রোহের রণডংকা যাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হতো উচ্চকিত কণ্ঠে সর্বদা। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অহংকার। তাঁকে নিয়েও এদেশের একশ্রেণির গোলাম এবং তাঁদের বশংবদদের বিকৃত ইতিহাস চর্চা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কোন এক গোলাম মুর্শিদ বিশদকার একটি বইতে লিখেছেন “রণবীর রণক্লান্ত”। 
তাঁকে এবং তাঁর সৃষ্টিকে বিকৃত করার জন্য মনে হয় অভিন্ন সুরে এসব গাথামালা ষড়যন্ত্র। এটা সবাই জানে বীররা কখনও ক্লান্ত হয় না। তাঁরা আমৃত্য সংগ্রামের সারথী হয়ে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান। বিদ্রোহী রণবীর কবি নজরুল অসুস্থ হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাই করেছেন।
এই মহান সাধক এ জনপদের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সর্বোপরি আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি নিপীড়িত সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। পিছিয়ে পড়া মজলুম মানুষের অনুপ্রেরণা জোগাতে চেয়েছেন; চেয়েছেন ব্রিটিশ হটিয়ে উপমহাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ঝান্ডা উড্ডীন করতে। এসব লক্ষ্য অর্জনে তিনি কলম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। রাজনীতির মাঠকে গরম করেছিলেন। স্ব-ধর্মের চেতনায় উজ্জীবিত থেকেও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সাধনে সচেষ্ট থেকেছেন। এককথায় তাঁর মধ্যে ছিলো স্বদেশ প্রীতি, স্বাধীনতা প্রীতি ও সাম্যবাদী মনোভাব।
তাই তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কালজয়ী এই গানটি লিখে স্বাধীনচেতা বাঙালিদের আন্দোলনে উজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন :
“কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙ্গে ফেল করবে লোপাট 
রক্ত-জমাট
শিকল-পূজায় পাষাণবেদী!
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ! 
ধ্বংস-নিশান
উঠুক প্রাচীর প্রাচীর 
প্রাচীর ভেদি’........
লাথি মার, ভাঙে তালা! 
যত সব বন্দী-শালায় 
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি”....
এই গানটি শুনলে স্বাধীনচেতা যে কোন মানুষের শিরা-উপশিরা আগুনের রশ্মির মতো টগবগ করতে থাকে। এটা শুধু গান নয়, বাঙালির আবেগও বলা যেতে পারে। দুর্ভাগ্য! গানটি বিকৃত করেছেন দিল­ী শাসিত পশ্চিম বাংলার একটি বশংবদ। ধিক্কার না জানিয়ে পারি না। যে গানটির সাথে জড়িয়ে আছে এই উপমহাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ঐতিহাসিক পটভূমিকা। সেই গানটি কেন বিকৃত করা হলো? এসব দেখে আজকে হতভম্ব, বিস্মিত গোটা বাঙালি। আজকে প্রতিবাদে উত্তাল বাংলাদেশ।
গানটির বয়স ১০২ বছর। শত বছর পর এই গানটির সুর বদল করা হয়েছে। বিকৃত করা হয়েছে। কেন করা হয়েছে? কেন? এ প্রশ্নের জবাব কী? বেশ ক’দিন ফুঁসে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতা। এতবড় স্পর্ধা, এতবড় সাহস কোথায় পেলো তাঁরা? কাঁদের ইঙ্গিতে এসব বিকৃত ইতিহাস। রক্তের আঁখরে লেখা কবি নজরুলের এই গানটির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের আলেখ্য ইতিহাস। এই গানটির সাথে মিশে আছে প্রতিটি মুক্তিকামী জনতার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সুরের ঝংকার। আজকে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি নিয়ে কেন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রিয় পাঠক আসুন সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক এই বিতর্কের রহস্য।
গানটি নিয়ে কেন বিতর্ক? : ইতিহাসকে বিকৃত করা দেশে দেশে নতুন কোন কথা নয়। তবে প্রকৃত ইতিহাস কোনদিন বিকৃত হয় না। ইতিহাস স্রোতস্বিনী বহমান একটি নদীর নাম। ইতিহাস চলে তার আপন গতিতে। কেউ তাকে বিকৃত করতে পারে না।
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাস। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল­া থেকে কলকাতা ফেরার পর রচনা করেন তার বিখ্যাত ‘ভাঙার গান’-“কারার ঐ লৌহ-কপাট ভেঙ্গে ফেল করবে লোপাট” এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ‘বল বীর চির উন্নত মম শির’। বাংলা সঙ্গীত ও কবিতার ইতিহাসে সর্বকালের সেরা বিপ্লবী গান আর কবিতা। 
এ দু’টি রচনা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নজরুলের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার এমন কিছু গান আছে যা শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। দেশাত্মবোধের ভাব মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তার মধ্যে অন্যতম নজরুলের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি। তার প্রতিটা কথা, সুর, ভাষা হৃদয়ে ছাপ ফেলে যায়।
দিন কয়েক ধরেই এই গানটিকে কেন্দ্র করে চলেছে নানা আলোচনা। এ শুধু গান নয়,বাঙালির আবেগও বলা যেতে পারে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘কারার ওই লৌহ কপাট’। যে গানের একেবারে রূপ বদল করে ফেলেছেন অস্কারজয়ী ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পী এ আর রহমান। 
এবার সেই কালজয়ী গানকেই ব্যবহার করা হল আসন্ন কোলকাতার হিন্দি ছবি ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটিতে। আর নতুনভাবে এই ছবির জন্য বিকৃতভাবে এই গানটি অ্যারেঞ্জ করেছেন। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, কোন নজরুল প্রেমিক বা সাধারণ মানুষ গানটি বিকৃত করাই স্বাভাবিক ভাবে কেউ মেনে নিতে রাজী নয়। সে গান শুনে মোটেই খুশি নন শ্রোতারা। বরং প্রতিবাদে, বিক্ষেভে ফেটে পড়েছে সর্বত্রই।
গানটির সুর মুক্তিকামী বিপ্লবী মানুষের মনে শত বছর ধরে গেঁথে আছে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু থেকে শুরু করে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল বন্দি অবস্থায় নিয়মিত এই গানটা গাইতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৯ সালে গানটা প্রথম রেকর্ড হলো। গিরীন চক্রবর্তীর গলায় সেই রেকর্ড বের হয় ১৯৪৯ সালের জুন মাসে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি থেকে। আর  সে বছরই ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছায়াছবিতে প্রথমবার ব্যবহৃত হয় গানটি। সেটাও গিরীন চক্রবর্তীর গলাতেই।
প্রতিবাদের ঝড় : অস্কারজয়ী এ আর রহমানের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘পিপ্পা’ নামে হিন্দি সিনেমাটি গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে অবলম্বনে করে তৈরি হয়েছে এই হিন্দি সিনেমাটি। যেভাবে গানটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতেই আপত্তি তুলেছেন নজরুল প্রেমিকসহ দেশ-বিদেশে অনেকে। 
সুর বদলের প্রতিবাদ করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ঢাকায় বসবাসরত নাতনি খিলখিল কাজীও। তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বলেছেন, “যেভাবে এ আর রহমান গানটির সুর বদল করেছেন, তা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। একে ‘অপরাধ’ হিসাবে তিনি বর্ণনা করেছেন”।
কলকাতার শিল্পী বাবজী সান্যাল বলছেন,-“এই গানটি অথবা রবীন্দ্রনাথ-“নজরুলের গানগুলোর সঙ্গে তো মানুষের ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। মি. রহমান যেভাবে সুর করেছেন, তার সঙ্গে গানটির ইতিহাস, প্রেক্ষিত এ গুলো একেবারেই  মেলে না। তিনি গানটিকে আধুনিক করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শেষমেশ এই বিখ্যাত গানটির একটি বিকৃত রূপ সামনে এনেছেন”।
গায়িকা ফাহমিদা নবী লিখেছেন, “এ আর রহমান নিজেই গুণী সুরকার। নিজের সুরে অন্য কথায় ছবির প্রয়োজনের গান করতেই পারতেন। সঠিক সুরে গানটি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাদের জাতীয় কবির প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি’’।
লেখিকা তামান্না ফেরদৌস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, “এ আর রহমানের সুর করা লৌহ কপাট গানটা শুনে মনে হলো, এই গান এবং এই গানের সাথে জড়িয়ে থাকা বাঙালির আবেগ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই কিংবা থাকলেও উনি সেভাবে আমলে নেননি। একজন অস্কার বিজয়ী শিল্পীর কাছ থেকে এই ধরনের উদ্ধতপূর্ণ অপেশাদার আচরণ কোনোভাবেই মেনে  নেয়া যায় না”।
‘ইতিহাসের বিকৃতি’ : এ সব ইতিহাস বিকৃতি। শত বছরের আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সাথে যে গানটি জড়িত জেনে-শুনে তা বিকৃতি করা অপরাধ ছাড়া কিছুই না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি এই গানটি ব্রিটিশ বিরোধী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এই গানটি শুনলে আমরা যে শক্তি পাই, তা মনে হয় না অন্য কোনো ভাষার গানে এ রকম শক্তি পাওয়া যায়। এই গানটি শুনলে আমাদের শরীরের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। স¤প্রতি ভারতের ‘পিপ্পা’ চলচ্চিত্রে গানটির সুর বিকৃত করে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা শুধু কবির প্রতি অসম্মানই নয়,বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতির প্রতি চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে।
বাঁশরী কবির গানে যে কোনো ব্যক্তির নতুন করে সুরারোপ কিংবা সুর পরিবর্তন চরম ধৃষ্টতা ছাড়া কিছুই না। কবির সব সৃষ্টি বাঙালি জাতি তথা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। এই কালজয়ী গানের বিকৃতি কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের চলচ্চিত্রে এই গানের বিকৃত সুরকে গোটা বাঙালি জাতি তীব্র ভাষায় নিন্দা এবং ধিক্কার জানাচ্ছে।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট ও আজাদবার্তা সম্পাদক।

্রিন্ট

আরও সংবদ