খুলনা | রবিবার | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বড়দের প্রতি ছোটদের করণীয়

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
১২:১৬ এ.এম | ০২ ডিসেম্বর ২০২৩


রসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের দয়া করেনা এবং আলেমের (হক) অনুধাবন করে না সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (মুসনাদে আহমদ)
বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন মুসলিম ঐতিহ্যের বিশেষ স্মারক ও নৈতিক শিক্ষার বিষয়। মুরব্বিদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া, বয়োবৃদ্ধদেরকে মাতা-পিতার মতো সম্মান দেখানো মানবিক মূল্যবোধেরই পরিচয় বহন করে। ইসলাম তাই মুরব্বিদের প্রতি সৎ আচরণ প্রদর্শনের তাগিদ দিয়েছে।
হযরত আবু উমামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু ওবায়দা ইবনে জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও সাহাবাদের এক জামাতের সাথে বসেছিলেন। তাঁর নিকট পেয়ালা আনা হল যাতে পানীয় জাতীয় কিছু ছিল। রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত পেয়ালা হযরত আবু ওবায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহুকে দিলেন। হযরত  হযরত আবু ওবায়দা রাযিয়াল­াহু আনহু বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি গ্রহণ করুন। রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল­াম বললেন, তুমি প্রথম পান কর, কেননা বরকত আমাদের বড়দের সাথে আছে। (হায়াতুস সাহাবাহ)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অর্থাৎ, একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমি মিসওয়াক করছি। এমন সময় আমার নিকট দু’জন ব্যক্তি এলো যাদের একজন অন্যজনের চেয়ে বয়সে বড়। এরপর আমি ছোটজনকে মিসওয়াক দিলাম। ফলে আমাকে বলা হলো বড়কে অগ্রাধিকার দাও। তখন আমি বড়জনকে মিসওয়াক প্রদান করলাম। (মুসলিম)
নবী কারীম সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় খায়বারে ইহুদী স¤প্রদায় বাস করত। কোন এক সময় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সাহল রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত মুহাইয়েসা ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু তারা উভয়ে খাইবারে গেলেন এবং খেজুর বাগানে গিয়ে উভয়ে একে অপর থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। সেখানে ইহুদীগণ আবদুল্লাহ ইবনে সাহল রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কাতল করে দিল। এই ব্যাপারে হযরত আবদুর রহমান ইবনে সাহল রাযিয়াল্লাহু আনহু, হযরত হুয়াইয়েসা ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত মুহাইয়েসা ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসলেন। উদ্দেশ্য ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার ভাইকে হত্যা করার ব্যাপারে নালিশ জানানো। হযরত আবদুর রহমান প্রথম কথা আরম্ভ করলেন। যেহেতু তিনি নিহতের ভাই ছিলেন, সেই সূত্রে তার ওয়ারিছ। কিন্তু সেখানে তার চাচাও উপস্থিত ছিলেন। আত্মীয়তার দিক থেকে যেহেতু চাচা অপেক্ষা ভাই-ই নিহত ব্যক্তির বেশি নিকটতম ছিল, তাই হযরত আবদুর রহমান মনে করেছিলেন- নালিশ জানানোর ব্যাপারে কথা বলা তারই কর্তব্য। কাজেই চাচা নিরব বসে থাকল এবং ভাই কথা বলতে শুরু করল। তখন নবী কারীম সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে ভাইকে থামিয়ে দিলেন যে, ‘বড়কে বড়ের মর্যাদা দাও।’ (বুখারী, হায়াতুস সাহাবাহ)
আলোচ্য হাদীস আলোচনা করতে গিয়ে সায়েখুল ইসলাম আল­ামা মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, অর্থাৎ তোমার সঙ্গে যখন তোমার চেয়ে বড় একজন উপস্থিত আছেন, তখন প্রথমে তোমার কথা বলা উচিত নয়; চাচাকেই প্রথমে কথা বলতে দেওয়া উচিত। তারপর যখন দরকার পড়বে, তুমিও কথা বলো, কিন্তু আগে বড়কে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ আদব। এ আদবের দাবি হল- গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে বড়কে সামনে এগিয়ে দেওয়া। যদি কোনও ব্যক্তিরা অন্য কোনও যোগ্যতা নাও থাকে, কেবল বয়সেই বড় হয়, তবে সেই বয়োজোষ্ঠ্যতারও একটা সম্মান আছে। সেই সম্মান তাকে দেওয়া চায়। সে হিসেবেই তাকে সামনে এগিয়ে দিতে হবে। তাকে পিছনে রেখে ছোট সামনে যাওয়ার চেষ্টা করো না। (ইসলাম আওর হামারী জিন্দেগী)
আমাদের খুব ভাল ভাবে মনে রাখতে হবে। যেহেতু জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বড়দের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, সেহেতু সুন্দর আচরণের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করা। তাদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার ও সদালাপি হওয়া। আদেশ-নিষেধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের নির্দেশ মোতাবেক চলার চেষ্টা করা। সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁদের অগ্রাধিকার দেয়া। কোনো কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সামনে রাখা। একত্রে হাঁটার সময় সামনে না হাঁটা। নাম ধরে না ডাকা। কোন প্রয়োজন হলে তাদেরকে পিছনের দিক থেকে না ডাকা। পরিবারে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা যানবাহনে বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বড়দের জন্য আসন ছেড়ে দেওয়া। তাদের সামনে উঁচু আওয়াজে কথা না বলা। বিনয় অবলম্বন করা। তাদর প্রতি কৃতজ্ঞ ও অনুগত হওয়া। অবাধ্য না হওয়া। কোনো প্রয়োজনে ডাকলে সাথে সাথে সাড়া দিয়ে উপস্থিত হওয়া। জ্ঞানের কারণে অহংকার না করা। বড় যদি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্নও হন, তবুও তাঁকে ছোট করে কথা না বলা। তাঁর সামনে ভুলেও বড়াই দেখাবে না। আমি যদি আজ তার মনে কষ্ট দিই, কাল অবশ্যই আমার চেয়ে ছোট কারও কাছ থেকে আমিও একই রকমের ব্যবহার পেয়ে যাব। ঔদ্ধত্য ও অহংকার আল­াহ পছন্দ করেন না। পরিবার ও সমাজের সর্বত্র, নম্রভাবে চলা উচিত। কর্মক্ষেত্রে আমার অধীন কেউ যেন আমার আচরনে কষ্ট না পায়। শ্রেণী-বৈষম্য ও ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকল ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা কিংবা অসৌজন্যমূলক আচরণ হতে নিজেকে হেফাজত করা। বড় যেই হোক আমার অধীনস্ত হলেও তাদের সালাম দেওয়া। মসজিদের কাতারে সামনের কাতারে তাঁদেরকে এগিয়ে দেওয়া। খিদমতের প্রয়োজন হলে খিদমত করা, যেমন বৃদ্ধ ব্যক্তিদের রাস্তা চলাচল বা পারাপারে সাহায্য করা, অসুস্থ হলে সেবা করা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া এবং তা পূরণ করার চেষ্টা করা। তাদের নিন্দা-সমালোচনা থেকে বিরত থাকা। সর্বোপরি তাদের জন্য দোয়া করা।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের বড়দের যথাযথ সম্মান করার তৌফিক দান করুন, আমিন।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
সংকলক: লেখক ও গবেষক।

্রিন্ট

আরও সংবদ