খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৭ কার্তিক ১৪৩১

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অমর সাহিত্যিক খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হক

এড. এম. মাফতুন আহমেদ |
১২:২২ এ.এম | ২৩ ডিসেম্বর ২০২৩


শৈশব কাল। কতো স্মৃতি, কতো কথা। জীবনের মধ্য গগনে মনে পড়ে। আমাদের এলাকা পাইকগাছার মানুষ। খুলনায় পড়াশুনা করে। পরবর্তীতে তিনি ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। বয়সে অনেক বড়। মরহুম পিতার প্রিয় ছাত্র। নাম কিরন চন্দ্র সরকার। তিনি আজ পরপারে। এতো অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা যে, তখন জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল খুবই কঠিন। খুলনা শহরের এক সম্মানীত ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন ‘তোমার বাড়ী কোথায় খোকন’? বললেন, পাইকগাছায়। ও আচ্ছা প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ‘আবদুল­াহ’ উপন্যাসের লেখকের বাড়ী । ঔই কলেজ ছাত্র আমাকে পরবর্তী কোন এক সময়ে প্রসঙ্গত বলেছিলেন-‘লোনা পানির মানুষ আমরা অনেকে আমাদের চিনতো না। চিনিয়েছিলেন সেদিন ‘আবদুল­াহ’ উপন্যাসের লেখক কাজী ইমদাদুল হক তাঁর কীর্তির মধ্য দিয়ে। আসলে কারোর অপরিসীম কীর্তির মাঝে একটি জাতি সমাজ গোষ্ঠি পরিচিতি লাভ করে। 
তাই তো যুগে যুগে, কালেভদ্রে জাতির মাঝে যুগশ্রেষ্ঠ কিছু অতি মানবের আগমন ঘটে। তাঁরা দিশাহীন জাতিকে আলোর দিশা দেখান। ছড়িয়ে দেন দেশ থেকে দেশান্তরে জ্ঞানের আলোকরশ্মি। তাই তাদেরকে বলা হয় কালজয়ী। জাতির কিংবদন্তী। এদের জীবন ধরণীর বুকে খুবই সংক্ষিপ্ত। এই ক্ষুদ্রপরিসর জীবনে এঁরা জাতিকে গহীন সাগর থেকে কুড়িয়ে এনে দিয়ে গেছেন অসংখ্য জ্ঞানের মনি মুক্তা। এরা নিজেকে চেনে না, খোঁজ রাখে না এদের পরিবার, এরা আসলে কী? আসলে নিজেকে নয়, জাতি-রাষ্ট্র, গোটা ভুবনকে নিয়ে নিরন্তর সাধনায় মত্ত থাকেন। তাই তো এদের বলা হয় জাতির মহীরুহ।
প্রবন্ধটি লিখতে যেয়ে মনে পড়ে গেল মহাকবি এমাসনের কথা। তিনি লিখেছেন “Great Poets have shortest biographies their cousing can tell you nothing about them,they live in their Poetry” অর্থাৎ (মহান কবিদের জীবনী খুবই সংক্ষিপ্ত। তাঁদের আত্মীয়রাও তাঁর সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে না, তাঁরা বেঁচে থাকবেন তাঁদের কাব্যে)। 
নিঃসন্দেহে কবি, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, কিশোর লেখক, সাংবাদিক কাজী ইমদাদুল হক। জাতির মহান পথিকৃতদের মধ্যে অন্যন্য একজন। তিনি রেখে গেছেন সাহিত্যের ভাণ্ডার। এক কথায় সাহিত্য কীর্তি। সৌম্যদর্শন ও প্রিয়ভাষী, মার্জিতরুচি ও মুক্তমন জ্ঞানপন্থী ও সমাজপেশী কাজী ইমদাদুল হক তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে অতুল কীর্তি রেখে গেছেন, তার মহাত্ম্য উপলব্ধি আজও আমাদের চিত্তের জাগরণে ও উৎকর্ষের জন্য অপরিসীম সহায়। অথচ এই তল­াটের মানুষগুলো আজ তাঁকে ভুলে যেতে বসেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সব জাতীয় মণিষীদের মূল্যায়ন করা দরকার। সেভাবে মূল্যায়িত হয় বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, “যে জাতি তাঁর কৃতিপুরুষদের মূল্যায়িত করতে জানে না, সে দেশে জাতীয় বীরের জন্ম হয় না”। মনে পড়ে গেল ফরিদা পারভীনের একটি গানের কলি। 
“বাড়ীর কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শি বসত করে.....
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে.....। 
বাড়ীর কাছের চেনা-অচেনা বাসিন্দাদের আমরা ভুলে যেতে বসেছি। বলা যায় বিস্মৃতিপ্রবণ দুর্ভাগা একটি জাতি। এক কথায় বলা যায়, বৃহত্তর খুলনার মানুষ জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান, জাতীয় বীর কাজী ইমদাদুল হককে আজ ভুলে যেতে বসেছি। 
নোনা পানির সোনার ছেলে : এই যুগপুরুষ ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দের ৪ নভেম্বর তারিখে খুলনা জেলার পাইকগাছা থানা (আজকে উপজেলা)র গদাইপুর কাজী বংশে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আতাউল হক প্রথম জীবনে কিছুদিন আসামের জরীপ বিভাগে চাকুরি করেছিলেন। পরে তিনি মুখ্তারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে খুলনার ফৌজদারী আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর আয় বেশী না হলেও তিনি পুত্রের শিক্ষা দীক্ষার প্রতি সর্বপ্রকার যতœ নিয়েছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালে প্রায় আশি বছর বয়সে ঢাকায় তাঁর পুত্রের ইস্কাটনস্থ বাসভবনে দেহত্যাগ করেন।
উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ : ইমদাদুল হক বাল্যকাল হতেই শান্তস্বভাব, মেধাবী ও পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি ১৮৯৬ সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯৮ সালে কলকাতা মাদ্রাসা থেকে এফ এ এবং ১৯০০ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি এ পাশ করেন। বি এ পড়বার সময় তিনি physics ও chemistry তে অনার্স নিয়েছিলেন কিন্তু পরীক্ষার প্রাক্কালে অসুস্থতাহেতু অনার্স ছেড়ে দিয়েছিলেন। অতঃপর ইংরেজিতে এম এ ও বি এল শ্রেণিতে পড়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে Bengal Civil Service এ প্রবেশ লাভের চেষ্টা করেন। তিনি খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নমিনেশন পেয়েছিলেন। কিন্তু provincial Executive service ও তাঁর ভাগ্যে লাভ হয়নি। তিনি ছিলেন সাহিত্যমনা জ্ঞানসাধক; তাই শিক্ষা বিভাগের দিকেই ছিল তার নিয়মিত নির্দেশ। 
চাকুরি জীবনে প্রবেশ : ১৯০৩ সালে তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় একটি অস্থায়ী শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ গঠিত হলে ১৯০৬ সালে অক্টোবর মাসে ইমদাদুল হক শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের অফিসে কেরানী’র পদে নিযুক্ত হয়ে শিলং গমন করেন।  কিন্তু শিলং-এর রমনীয় প্রাকৃতির পরিবেশেও কেরানী’র চাকুরি তাঁর কবি-মেজাজের অনুকূল হলো না; অগত্য চলে এলেন এক বছর পরে ছুটি নিয়ে এলেন স্বদেশে।
শিক্ষা বিভাগের তৎকালীন ডিরেক্টর মি. শার্প তাঁর সম্ভাবনাময় জীবন আলেখ্য জানতে পেরে ১৯০৭ সালে তাঁকে ঢাকা মাদ্রাসার শিক্ষক পদে নিযুক্ত করেন। ১৯১১ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সালে তিনি provincial Education service এ উন্নীত হয়ে ঢাকা বিভাগের Assistant Inspector of Schools for Muhammadan Education পদ লাভ করেন। ১৯১৭ সালে তিনি কলকাতা ট্রেনিং স্কুলের হেডমাস্টার পদে বদলী হন। তিনি যখন ঢাকা ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক, তখনই মূত্রাশয়ের পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। বড় রকমের  অস্ত্রোপাচার হয় এবং সেখানে তাঁকে দীর্ঘ ছয় মাস কাল অবস্থান কালে তিনি তাঁর  ‘আবদুল­াহ’ উপন্যাসের অধিকাংশ  রচনা করেন। 
‘আবদুল­াহ উপন্যাস ছিল তাঁর অমর কীর্তি : ‘আবদুল­াহ’ উপন্যাস তিনি দেখে যেতে পারেননি। হাসপাতালে বসে এই উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলেন। শেষ নামাতে পারেননি। ৩০ পরিচ্ছেদ ‘মোসলেম ভারতে’ প্রকাশিত হয়েছিল। তার পরের ১১ পরিচ্ছেদ রচনা করেন অধ্যাপক কাজী আনোয়ারুল কাদীর। এই অংশটুকুর খসড়া ইমদাদুল হক রেখে গিয়েছিলেন। এভাবে তৈরী ‘আবদুল­াহ’। ১৯৩৩ সালে ‘দি মুসলিম প্রেস, ১১/৫ নং কড়েয়া বাজার, কলকাতা থেকে মুদ্রিত ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় সংস্করণ ঢাকা থেকে ‘প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি’ তার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
তোমার কীর্তির চেয়ে .....: প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। মায়ার পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। একটু আগে আর পরে। এই মহান সাধক মাত্র ৪৪ বছরের কম বয়সে জীবন গাড়ী থেমে যায়। ১৯২৩ সালের গোড়ার দিকে তিনি জরারোগে এমন আক্রান্ত হন যে, তাঁর জীবনের আশা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তিনি ঢাকা নগরীর উত্তর প্রান্তে ইস্কাটন অঞ্চলে ‘সাড়ে সাত হাজার টাকা’ ব্যয় করে ‘মাটির দেয়াল ও টিনের ছাদ’ দিয়ে নিজস্ব বাটী নির্মাণ করেছিলেন; সেই স্নিগ্ধ শ্যামল পরিবেশে তাঁর কবি প্রাণ শান্তির সন্ধান পেয়েছিল; কিন্তু সেখানে এক বছরের কাল বাসের পরই ম্যালেরিয়ার কবলে পড়েন। মনের অসাধারণ শক্তির বলেই তিনি সে যাত্রা রক্ষা পান।
সে আনন্দ কাটতে না কাটতে মূত্রাশয়ের পীড়া পুনর্বার দেখা দেয়। তিনি হেকিমী মতে চিকিৎসার্থে দিল্লী যাত্রা করেন। পথে কলকাতা অবস্থান কালে ১৯২৬ সালের ২০ মার্চ রাত্রে  ৪৪ বছরেরও কম বয়সে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে পরাপারে পাড়ি জমান জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। কলকাতার  ‘গোবরা’ গোরস্থানের তাঁর জননীর সমাধির অনতিদূরে তাঁকে শেষবারের মতো শায়িত করা হয়। সেখানেই ঘুমিয়ে আছেন সাহিত্য অঙ্গণে ধ্র“বতারা মরহুম কাজী ইমদাদুল হক। তিনি কাব্যে, সাহিত্য, শিক্ষাঙ্গণে অমর হয়ে আছেন। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি মরেও অমর গোটা বাঙালি জাতির কাছে অক্ষয় হয়ে থাকবেন।

্রিন্ট

আরও সংবদ