খুলনা | রবিবার | ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন : খুলনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এইডস রোগ

বশির হোসেন |
১২:৫১ এ.এম | ০৬ এপ্রিল ২০২৪


খুলনার ফুলতলার বাসিন্দা গৃহবধূ আকলিমা (ছদ্মনাম)। সিজার করিয়েছিলেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে আল শেফা নামে একটি হাসপাতাল থেকে। সন্তান জন্ম দেয়ার কিছুদিন পর জ্বর-সর্দি নিয়ে যান হাসপাতালে দু’দফা ওষুধ খেয়ে পূর্ণ সুস্থ্য না হওয়ায় চিকিৎসক এইচআইভি পরীক্ষা দেন। ঐ গৃহবধূর এইচআইভি পজেটিভ ধরা পরে। তার স্বামীর এইডস না হওয়া ও রোগীর অন্যান্য বক্তব্য পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন সিজারের সময় যে রক্ত নেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পরীক্ষা করে নেয়া হয়নি। অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চলনে ঐ গৃহবধূর জীবনে নেমেছে স্থবিরতা। খুলনা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীর মাকে কয়েকদিন আগে অপারেশন করা হয়েছিলো নগরীর ডক্টরস পয়েন্ট ক্লিনিকে। এই ছাত্রীর মায়ের ক্ষেত্রেও খুলনায় অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনকে দায়ী করছে চিকিৎসকরা। এছাড়া একই ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে পিরোজপুর ও নড়াইল থেকে খুলনায় চিকিৎসা করতে আসা দুইজন রোগীর ক্ষেত্রে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি (এরআরটি) সেন্টারের দেয়া তথ্য মতে, খুলনায় এইডসের সংক্রমণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ বিভাগের মধ্যে এইডস ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে খুলনা জেলায়। খুলনা জেলায় বর্তমানে এইচ আইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২২২ জন। এর মধ্যে ১২০ জন রয়েছে সাধারণ মানুষ যারা এইডস-এর ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠি বা তাদের সংস্পর্শে কখনও আসেনি। এছাড়া শিশু রয়েছে ১১ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। গত ৪ বছরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, খুলনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এইডস আক্রান্তের হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। খুলনায় ২০২০ সালে সাধারণ মানুষ যেখানে ৬ জন ছিলো তিন বছরের মাথায় এই এই সংখ্যা এখন ৫০। ২০২০ সালে খুলনায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ১৪জন, ঐ বছর মৃত্যু হয়েছিলো ১ জনের, ২০২১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জনে এবং মৃত্যু ৫, ২০২২ সালে ৩৮ জন আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যু হয় ৮ জনের, ২০২৩ সালে আক্রন্ত হয় ৪১ এবং মৃত্যু হয় ৮ জনের। তবে এইড আক্রান্তদের মধ্যে একটি বড় অংশ আক্রান্ত হয় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির মধ্যে। তবে সাধারণ মানুষের এইডস এ আক্রান্ত হওয়া এবং দিন দিন এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ ইঙ্গিত উলে­খ করেছেন এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। 
এর মধ্যে তালিকায় রয়েছে পুরুষ যৌনকর্মী ২০, মহিলা যৌন কর্মী ২৯, সমকামী ৩৮ জন, হিজরা ২, যক্ষা রোগী ২ জন, যৌনকর্মী (পার্টনার) তিনজন, হিজড়া ৩ জন, যৌনকর্মী (পার্টনার) তিনজন, হিজড়া ২ জন, বিদেশে অবস্থান (আসা যাওয়া) ৫ জন, এইডস পার্টনার ২ জন।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ এসএম কামাল সময়ের খবরকে বলেন, আমরা সব সময় দেখেছি অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এবং এই রিলেটেড কিছু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো কিন্তু বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে দিন-দিন এইডস ছড়াচ্ছে। এর অর্থ হল এইডস নির্মূলে সরকারের পদক্ষেপগুলো এক সাথে কাজ করছে না। বিশেষ করে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন-এর জন্য প্রধান দায়ী বলে মনে করেন মেডিসিনের এ বিশেষজ্ঞ।  
অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে বাড়ছে আক্রান্ত রোগী : খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, খুলনায় বেসরকারিভাবে দেড়শতাধিক ক্লিনিক হাসপাতালের লাইসেন্স থাকলেও রক্তপরিসঞ্চালন-এর ক্ষমতা রয়েছে সরকারি-বেসরকারি মিলে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, খুলনা শহরের প্রায় শতভাগ ক্লিনিক ও হাসপাতাল তাদের হাসপাতালের অপারেশনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে কোন রোগীর শরীরে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হলেও তেমন কোন পরীক্ষা-নীরিক্ষা ছাড়াই একজনের রক্ত অন্যজনের শরীরে প্রদান করা হচ্ছে। এতে এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কথা বললে, তারা রক্ত পরিসঞ্চালনের বিষয়টি আমলেই নেননি। তারা বলেন, সরকার ক্লিনিক ও হাসপাতালের লাইসেন্স দিয়েছে তবে রক্ত টানতে পারবো না এ কোথাও বলা নাই।
খুমেক হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, এখানে প্রতিটি রোগীকে রক্ত প্রদানের আগে দাতার শরীরে রক্ত গ্র“পিং এইচআইভি, হেপাটইটিস বি, সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিসসহ ৭টি পরীক্ষা করা হয়। যার প্রতিটি রোগীর কাছ থেকে ২৫০ টাকা হারে নেয়া হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সদস্য সচিব ডাঃ জিল­ুর রহমান সময়ের খবরকে বলেন খুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বড় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া আর কোন প্রতিষ্ঠানের রক্ত পরিসঞ্চালন লাইসেন্স নাই। বেশিরভাগ ছোট ছোট ক্লিনিক হাসপাতালগুলো বিভিন্ন স্থান থেকে রোগী এনে তাদের অপারেশ বা যে কোন কারণে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হলে কোন নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই রক্ত দিয়ে দেয়। বাধ্যতামূলক পরীক্ষাগুলো তা করে না। যার ফলে এইডস-এর মত মরণঘাতি রোগ ছাড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এখানে দু’টি কাজ করা যায় প্রত্যেকটি হাসপাতাল ক্লিনিকের লাইসেন্স প্রদানের আগে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ থেকে আগেই লাইসেন্স নিতে হবে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে তাহলে এই সমস্যা কিছুটা কমবে। তবে এই মুহূর্তে রোগীদের পরামর্শ হল কোন রোগীরা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকেই রক্ত পরিসঞ্চালন করে ব্যবহার করবে। খুমেক হাসপাতালে একটি আধুনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ রয়েছে, যা ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। এছাড়া অন্য বড় দু’টি সরকারি হাসপাতালেও সঠিকভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে রক্ত দেয়া হয়। রোগীদের বেশি টাকা খরচ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেলে একদিকে টাকার অপচয় অন্যদিকে এইডস-এর ঝুঁকি।
তবে ডায়ালাইসিসসহ অন্যান্য অপারেশনে এইডস রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা: প্রত্যেকটি অপারেশনের আগে এইচআইভি টেস্ট করা বাধ্যতামূলক থাকলেও খুলনা মেডিকেল কলেজ, আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালের কোনটিতে এই নিয়ম যথাযথভাবে মানা হয় না। এছাড়া খুলনার দু’টি সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস থাকলেও সেখানে এইডস আইভি রোগীদের ডায়ালাইসিস দেয়া হয় না। এইডস আক্রান্ত কোন রোগীর ডায়ালাইসিস বা কোন অপারেশনের প্রয়োজন হলে খুলনায় তা সম্ভব নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগী নিজের রোগের তথ্য গোপন করে ফলে এইডস-এর মারাত্মক ঝুঁকি তৈরী হয়।খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার (মেডিসিন) ও এআরটি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. দীপ কুমার দাশ বলেন, এই হাসপাতালে এইচআইভি আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য ‘প্রিভেনশন মাদার টু চাইল্ড ট্রান্সমিশন’ (পিএমসিটি) নামে একটি প্রোগ্রাম চালু আছে। এই প্রোগ্রামে এইচআইভি/এইডস পজিটিভ নারীর গর্ভের সন্তনটি যেন এইচআইভি নেগেটিভ হয়, সে সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ সেন্টার থেকে সব পর্যায়ে মানুষের জন্য বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। একইসঙ্গে এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিদের সব ধরনের পরীক্ষা এবং ১৫-১৬ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়।