খুলনা | সোমবার | ২৩ জুন ২০২৫ | ৯ আষাঢ় ১৪৩২

শোক-শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ‘সোর্ড অব অনার’

নানার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত বৈমানিক আসিম জাওয়াদ

খবর প্রতিবেদন |
০১:১০ এ.এম | ১১ মে ২০২৪


বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারানো স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদকে মানিকগঞ্জ শহরের সেওতা কবরস্থানে চিরসমাহিত করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে ‘সোর্ড অব অনার’ সম্মাননাপ্রাপ্ত জাওয়াদকে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে দাফন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন তার বাবা ডাঃ মোঃ আমান উল­াহসহ আত্মীয়-স্বজন এবং বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাসহ হাজারো মানুষ।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে জাওয়াদের মরদেহ বহনকারী বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার মানিকগঞ্জ শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়ামে পৌঁছায়। হেলিকপ্টার থেকে তার মরদেহের কফিন কাঁধে করে নামিয়ে আনেন জাওয়াদের সহকর্মী বিমান বাহিনীর সদস্যরা। ছেলের মরদেহবাহী কফিন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা নীলুফা আক্তার খানমসহ তার স্বজনরা। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ। জুমার নামাজের পর ওই স্টেডিয়াম মাঠে জাওয়াদের তৃতীয় জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। সেখান থেকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় সেওতা কবরস্থানে।
তারও আগে ঢাকায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে বৈমানিক জাওয়াদের ‘ফিউনারেল প্যারেড’ এবং দ্বিতীয় জানাজার নামাজ সম্পন্ন হয়। সেখানে তার মরদেহে দেওয়া হয় ‘গার্ড অব অনার’।
বৈমানিক জাওয়াদের প্রথম জানাজা সম্পন্ন হয় চট্টগ্রামের বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি জহুরুল হকের প্যারেড গ্রাউন্ডে।
মায়ের আহাজারি : চট্টগ্রামে বিমানবাহিনীর বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানের নিহত বৈমানিক আসিম জাওয়াদের (৩২) মা নিলুফা আক্তার খানমের আহাজারি এখনো থামেনি। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে জেলা শহরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষও মর্মাহত। শুক্রবার তাঁরা শোক ও ভালোবাসায় শেষবিদায় জানিয়েছেন কৃতী বৈমানিক আসিম জাওয়াদকে।
সকালে জেলা শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকার বৈমানিক আসিমদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে মা নিলুফা আক্তার খানম আহাজারি করছিলেন। সন্তানের মুখখানি দেখতে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। শোকাহত স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বৈমানিক স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মরদেহ নিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। এ সময় মরদেহের সঙ্গে নিহতের বাবা আমান উল­াহ, স্ত্রী অন্তরা খানম এবং দুই শিশুসন্তানও ছিল। এর আগে থেকে সেখানে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও নানা শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ ভিড় করেন। এর কিছুক্ষণ আগে বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার আননুরের নেতৃত্বে ৫০ জন সদস্য সড়কপথ হয়ে স্টেডিয়ামে আসেন।
বৈমানিক আসিম জাওয়াদের মরদেহ আনার পর স্টেডিয়াজুড়ে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। একমাত্র সন্তানের মরদেহ আনার পর মা নিলুফা আক্তার মাঠেই আহাজারি করতে থাকেন। ‘আমার বাবা (সন্তান) আমাকে কেন রেখে চলে গেল। আমার কী দোষ ছিল! কেন আমার বুক খালি হলো।’ বলছিলেন আর আহাজারি করছিলেন নিলুফা আক্তার।
হেলিকপ্টার থেকে আসিম জাওয়াদের মরদেহ নামিয়ে ফ্রিজিং এ্যাম্বুলেন্সে রাখা হয়। পরে জেলা ক্রীড়া সংস্থার মিলনায়তনে মরদেহ নেওয়া হয়। সেখানে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয় স্বজনেরা আসিম জাওয়াদকে শেষবারের মতো দেখে নেন।
জুমার নামাজের পর শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়ামে আসিম জাওয়াদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশার শত শত মানুষ অংশ নেন। জানাজার আগে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, নিহত বৈমানিক আসিম জাওয়াদ পরিবারের শুধু সন্তান ছিলেন না; তিনি দেশের সম্পদ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এ জেলা একজন কৃতী সন্তানকে হারালো।
জানাজার আগে আসিম জাওয়াদের বাবা ডাঃ আমান উল­াহ বলেন, ‘আসিম জাওয়াদের দু’টি শিশুসন্তান রয়েছে। আমরা যেন ওদের মানুষের মতো মানুষ করতে পারি। ওরা যেন বাবার অভাব বুঝতে না পারে। আসিম যেন বেহেশতবাসী হয়, সবাই দোয়া করবেন।’
জানাজা নামাজের পর বেলা আড়াইটার দিকে ফ্রিজিং গাড়িতে করে বৈমানিক আসিম জাওয়াদের মরদেহ জেলা শহরের উত্তর সেওতা কবরস্থানে নেওয়া হয়। সেখানে বিমানবাহিনীর রীতি অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকতা শেষে নানা মরহুম মোহাম্মদ রউফ খানের কবরে দাফন করা হয় এই পাইলটকে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) চট্টগ্রাম বোট ক্লাবের অদূরে কর্ণফুলী নদীতে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ।
নিহত আসিম জাওয়াদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার দরগ্রাম ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের ডা. মোহাম্মদ আমানউল­ার ছেলে। তার মায়ের নাম নিলুফা খানম। ২০১৬ সালে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ অন্তরা খানমকে বিয়ে করেন। তাঁদের আয়েজা খানম নামের ছয় বছরের এক মেয়ে এবং এক বছরের এক ছেলে রয়েছে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ বিমানটিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে দুই বৈমানিক অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে বিমানটিকে বিমানবন্দরের কাছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।