খুলনা | শুক্রবার | ১১ জুলাই ২০২৫ | ২৭ আষাঢ় ১৪৩২

ন্যায়বিচার ও ইসলাম

ড. মুহাম্মদ বেলায়েত হুসাইন |
০১:৩৮ এ.এম | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

পবিত্র কুরআনে কারীমায় মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার ফয়সালা করবে, তখন অবশ্যই ন্যায়বিচার করবে’(সুরা নিসা : ৫৮)
ন্যায়বিচার হচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি যা তার প্রাপ্যতা ও ভাল মন্দের ভাগের অনুপাতের তত্ত্বাকে নির্দেশ করে। যেখানে ভালোবাসা, শত্র“তা কিংবা বংশ মর্যাদার প্রভাব কোন কাজ করে না।
জীবনের সর্বক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিহার্য। কারণ, ন্যায়বিচার ছাড়া মানব জীবনের কোনো ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না।
ইসলামের উদার নৈতিক ইতিহাস হতে আমরা দেখতে পাই, মাত্র অল্প সময়ের ভিতরেই ইসলাম সমগ্র পৃথিবীর চিত্র বদলে দিয়েছিল, তার রহস্যটা কী ছিল? রহস্যটা এই ছিল যে, এই ধর্মের যারা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তারা যে কাজগুলো অন্যকে করতে আদেশ করেছেন, আগে নিজেরাই সেই কাজগুলো করে দেখিয়েছেন। ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারীরা ন্যায়বিচারের গুরুত্বই শুধু বর্ণনা করেননি, ন্যায়বিচারের উজ্জল দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। যেখানে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম, বর্ণ-শ্রেণি, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ধনী-দরিদ্র, প্রভু-ভৃত্য কোথাও বিন্দুমাত্র হেরফের করা হয়নি। তারা পক্ষপাতিত্ব, প্রভাবিত, আবেগতাড়িত হয়ে কোন বিচারকার্য পরিচালনা করেছেন এমন একটি ছোট্ট ঘটনাও ইতিহাসে পাওয়া যাবে না।
স্বয়ং খলীফার সামনে খলীফারই বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা এবং খলীফা তা মাথা পেতে মেনে নেওয়ার মতো ঘটনা ইসলাম ছাড়া আর কোন ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ খলীফা নির্দোষ, শুধু সাক্ষীর অভাবে নির্দোষ খলীফার বিরুদ্ধে তারই বিচারক রায় প্রদান করলেন। জঙ্গে জামালের দিন! খলীফা হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহুর একটি বর্ম হারিয়ে গেল। এক ব্যক্তি পেয়ে অপর এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিল। হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহু এক ইয়াহুদীর কাছে সেই বর্ম দেখে চিনে ফেললেন এবং উক্ত ইয়াহুদীর বিরুদ্ধে কাজী শুরাইহের আদালতে মামলা দায়ের করলেন। সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করলেন হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহুর পক্ষে তার পুত্র হযরত হাসান রাযিয়াল­াহু আনহু ও কাম্বার নামের হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহুর আযাদ করা এক গোলাম কে। কাজী শুরাইহ বললেন, হযরত হাসান রাযিয়াল­াহু আনহুর স্থলে অন্য কোন সাক্ষী হাজির করুন। হযরত আলী রাযিয়াল­াহু আনহু বললেন, আপনি কি হাসানের সাক্ষ্যও গ্রহণ করবেন না? কাজী শুরাইহ বললেন, না। কারণ আপনার মুখেই এই কথা শুনেছি যে, পিতার পক্ষে পুত্রের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।
ওমর ইবনে খাত্তাব রাযিয়াল­াহু আনহুর সময়ের ঘটনা, তৎকালীন মিশরের গর্ভনর আমর ইবনে আস রাযিয়াল­াহু আনহুর ছেলে কারো সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে গেল ফলে রাগান্বিত হয়ে তাকে মেরে বসল। সেই মিশরী খলীফা ওমর রাযিয়াল­াহু আনহুর নিকটে বিচার প্রার্থনা করল। হযরত ওমর রাযিয়াল­াহু আনহু হযরত আমর রাযিয়াল­াহু আনহু ও তার ছেলেকে পত্র মারফত মদীনাতে ডেকে আনলেন। মিশরীর হাতে চাবুক তুলে দিলেন আর বললেন বদলা নিয়ে নাও। উক্ত ব্যক্তি চাবুক মারছিল, আর হযরত ওমর রাযিয়াল­াহু আনহু বলছিলেন, কমজাতদের ছেলেকে মার।(হায়াতুস সাহাবাহ) ভেবে অবাক হতে হয় সাধারণ একজন বিচার প্রার্থী মিশরের গর্ভনরের ছেলেকে তার সামনে চাবুক মেরে বদলা নিচ্ছে আর গর্ভনর তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ইসলামের ইতিহাস ছাড়া এমন অনন্য ঘটনা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পৃথিবীর আদী হতেই ধনীরা গরীবের ওপর, মালিক শ্রমিকের ওপর, শক্তিশালী দুর্বলের ওপর, পদস্থরা অধীনস্তদের ওপর জুলুম করে আসেছে। ইসলামের আগমনের পরে ইসলাম সমস্ত প্রকার জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং ইনসাফ ও ন্যায়বিচার কায়েম করে যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
একজন মুসলমান ও এক ইয়াহুদী উভয়ের মধ্যে কোন বিষয়ে মিমাংসার জন্য একবার হযরত ওমর রাযিয়াল­াহু আনহুর কাছে আসল। তিনি দেখলেন ইয়াহুদী হকের উপর আছে। তাই তিনি ইয়াহুদীর পক্ষে ফয়সালা করে দিলেন।(তারগীব)
একবার এক ইয়াহুদী তার দাসীর মাথা দু’টি পাথরের মাঝখানে রেখে থেতলিয়ে দিয়েছিলো। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কে তোমাকে এমন করেছে? ইয়াহুদীর পরিচয় পাওয়ার পর ইয়াহুদীকে ধরে আনা হলো। সে তার অপরাধ স্বীকার করল। এরপর তাকেও অনুরুপ শাস্তি দেওয়া হল।(বুখারী)
আরবে তৎকালীন সময়ের সম্ভ্রান্ত পরিবার বনী মাখযুম গোত্রের এক মহিলা চুরি করল। রসূলাল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম ইসলামের বিধানমতে তার শাস্তির রায় দিলেন। সম্ভ্রান্ত পরিবারের হওয়ায় তার শাস্তি মওকুফ করার জন্য রসূলাল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামের নিকট সুপারিশ আসল। আল­াহর রসূল চরম রাগান্বিত হলেন। তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা এই জন্যই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের মধ্যে প্রতিপত্তিশালী ভদ্র ঘরের কেউ যদি চুরি করত তবে তারা তাকে ছেড়ে দিত আর দুর্বল কোন ব্যক্তি চুরি করলে তার উপর হদ প্রয়োগ করত। এরপর আল­াহর রসূল বললেন, আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করত তাহলে তাকেও এই একই শাস্তি দিতাম। রসূলাল­াহ্ সল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম তার শাস্তিকে বলবত রাখলেন।(বুখারী)
শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নয় পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। যেমন মাতা-পিতা-সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়, প্রতিবেশী, মেহমান-মেজমান একে অপরের প্রতি ইনসাফ কী হবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মাতা-পিতা বার্ধক্যে পৌঁছলে এই অবস্থায় কখনও তাদেরকে উহ্ বলবে না এবং তাদেরকে ধমক দিবে না। এমনকী মাতা-পিতা অমুসলিম হলেও তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে। কন্যা সন্তানের উপর পুত্র সন্তানকে প্রধান্য দেবেনা, হাদীয়া দেওয়ার ব্যাপারেও সন্তানদের মধ্য সমতা রক্ষা করবে। তোমরা স্ত্রীদের সাথে সদাচরনের মাধ্যমে ঘর-সংসার করবে, যখন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে তখন পরিপূর্ণভাবে সহবাস করবে যেন তাড়াহুড়া করবে না। স্বামী যখন তার প্রয়োজনে স্ত্রীকে ডাকবে স্ত্রী অবশ্যই তার নিকট চলে যাবে যদিও সে চুলার উপর ব্যস্ত থাকে। আত্মীয়-স্বজনকে তাদের প্রাপ্য হক প্রদান করবে, কোন অবস্থাতেই আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। প্রতিবেশীর সম্মতি ব্যতিত নিজের বাড়ি উঁচু বানাবে না যাতে তার বাড়ির বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। রোগীর কাছে বেশিক্ষণ অবস্থান করবে না। অন্যের ঘরে তার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করবে না। একদিকে মেজমানকে বলা হয়েছে, ‘যে মেহমানদারি করে না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। অপরদিকে মেহমানকে বলা হয়েছে ‘মেহমানদারি তিন দিন। তিন দিনের বেশি মেহমানদারি করা সদকা’। খাদেমদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তোমরা যা পরবে তাদেরকেও তাই পরতে দেবে, তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তাই খেতে দেবে। একজন ঘুমন্ত ব্যক্তির হকের ক্ষেত্রেও খেয়াল করা হয়েছে, সর্তকতার সাথে নিঃশব্দে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বাইরে আস যাতে করে দরজার শব্দে ঘুমন্ত ব্যক্তি জাগ্রত হয়ে অস্থির হয়ে না পড়ে।
এখানেই শেষ নয়, পশু-পাখির প্রসঙ্গেও ইসলামে উপেক্ষিত হয়নি যেখানে দিকনির্দেশনা রয়েছে অনন্য। অকারণে পশু-পাখিকে মেরে ফেলা, খাওয়ার জন্য ছাড়া হত্যা করা, অঙ্গহানী ঘটান, অহেতুক নিশানা বানানো, নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য তাদের কষ্ট দেওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হালাল যেসব পশুর গোশত খাওয়ার অনুমতি ইসলাম দিয়েছে, সেগুলো জবাই করার সময় তাদের সঙ্গে সদয় আচরণ ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। বলা হয়েছে, কোন প্রাণী কে যেন ক্ষুধার্ত অবস্থায় জবেহ করা না হয় এবং এমন ছুরি দিয়ে জবেহ করতে হবে ছুরি যেন ভোতা না হয় ধারাল হয় যাতে তাদের কষ্ট কম হয়।
একটি পরিবার, সমাজ, গোত্র বা দেশর মানুষের চেতনা, বিবেক ও দায়িত্বশীলতা কতটা সুস্থ স্বাভাবিক এবং ইতিবাচক হবে তা নির্ভর করে সেই স্থানের ন্যায়বিচারের উপরে। ন্যায়বিচার এগুলোর প্রাণশক্তি। ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো পরিবার, সমাজ, গোত্র বা দেশে নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে না। সমাজিক আইন, রীতি-নীতি, অধিকার, কর্তব্য সমস্তকিছুর পিছনেই অন্যতম নিয়ামক হচ্ছে ন্যায়বিচার। তাই পরিবার, সমাজ, গোত্র বা দেশের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
মহান আল­াহ তা’য়ালা আমাদেরকে একে অপরের প্রতি ইনসাফ করার তৌফিক দান করুন।(আমিন)।
লেখক : বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।