খুলনা | সোমবার | ২৩ জুন ২০২৫ | ৯ আষাঢ় ১৪৩২

জিপিএ-৫ পেয়েছে শয্যাসায়ী আরিফা

‘ভয় হয় আমার স্বপ্ন পূরণের আগেই যেন ভেঙে না যায়’

মোহাম্মদ মিলন |
০১:২৫ এ.এম | ১৫ মে ২০২৪


আম্মু জায়নামাজে কাঁদছিল। আমার জন্য দোয়া করছিল, মোনাজাতে কান্না করছিল। যখনই রেজাল্ট দেখি তখনই আমি গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমি আর আমার আম্মু একসঙ্গে কাঁদছিলাম ওই সময়। এ রকম একটা মুহূর্ত যে আসবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মা দিবসে আমার মাকে সবচেয়ে বড় একটা উপহার দিতে পেরেছি। এতে আমি খুব গর্ববোধ করছি। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি এ রকম ফলাফল করবো কল্পনাও করিনি। ‘ভয় হয় আমার স্বপ্ন পূরণের আগেই যেন ভেঙে না যায়’। 
এভাবেই বলছিলেন অসুস্থ হয়ে ঘরের বিছানায় থাকা মেধাবী শিক্ষার্থী আরিফা জান্নাত আসফি। প্রায় এক বছর ধরে কোমরে ব্যথা ও পেশিতে খিচুনি (muscle spasm) রোগে আক্রান্ত আরিফা। বেশিক্ষণ বসে থাকতে না পারায় লেখাপড়া করেন শুয়ে থাকে। খুলনার সরকারি ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী আরিফা এবারের এসএসসি পরীক্ষার সময় কখনও বসে কখনও শুয়ে পরীক্ষা দেন। কয়েকদিন এ্যাম্বুলেন্সে করেও খুলনা জিলা স্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রে যেতে হয়েছে তাকে। তার এই কষ্ট অবশেষে সার্থক হয়েছে। জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু অর্থাভাবে তার চিকিৎসা ও পরবর্তী লেখাপড়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। 
বাবা আতিয়ার রহমান আনসার সদস্য এবং মা সুলতানা পারভীন গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে বড় আরিফা। ছোট বোন আশরাফি আল শোভা এবার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। নগরীর ময়লাপোতা মোড় এলাকার একটি কোয়াটারে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন তারা।  
এক বছরের ব্যবধানে কোমর ব্যথার অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছে আরিফার জীবনের দুরন্তপনা। গত বছরও স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ৪০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় পুরস্কার জিতেছে এ মেধাবি শিক্ষার্থী। অথচ বছর ঘুরতেই বাড়ির বিছানায় শুয়ে-বসেই দিন কাটছে তার। এমনকি এসএসসি পরীক্ষায়ও লিখেছেন কেন্দ্রে শুয়ে-বসে।  
আরিফা জান্নাত আসফি বলে, পরীক্ষার সময় খুব অসুস্থ ছিলাম। পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবার সময় খুব কষ্ট হয়েছে, বসতেও পারতাম না। বাকি শিক্ষার্থীদের মতো আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি। শুয়ে শুয়েই লিখেছি। এমনও হইছে লিখতে লিখতে আমার হাত অবস হয়ে গিয়েছে। তখন একটু বসে ছিলাম, এমনও হইছে পরীক্ষা দিতে দিতে বাইরেও বের হয়েছি। কিন্তু চেষ্টা করেছি যতটুকু আমি লিখে আসতে পারি। পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো ছিল, প্রশ্নও কমন পড়েছিল। কিন্তু জানা জিনিস আমি লিখে আসতে পারিনি। কারণ আমার হাত অবস হয়ে যেতো। শুয়ে শুয়ে কতোটা লেখা সম্ভব, যতোটা পেরেছি, ততোটা লিখেছি। ভালো পরীক্ষা আমি দিয়ে আসতে পারিনি। গত বছরও বিদ্যালয়ের দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার শারিরীক অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে রোববার খুশির দিনে সহপাঠীরা কতো আনন্দ করেছে, কিন্তু আমি আসলে পারিনি। তাদের সঙ্গে দিনটা উদ্যাপন করতে পারিনি। এভাবেই দিনটা পার করেছি। আমারও ইচ্ছা করে বাকিদের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। কিন্তু আমি সেটা পারি না। এখন আমার বিছানায় পড়তে হয়, বিছানায়ই খেতে হয়। শুয়ে থাকলে একটু সুস্থবোধ করি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ি। 
আরিফা জান্নাত বলে, ভেবেছিলাম এবার পরীক্ষা দেব না, কিন্তু শিক্ষকরা বলেছিল আমি পারবো। অবশেষে পরীক্ষায় ভালো করেছি। আমার বাবা-মা, শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজনসহ সকলের দোয়া এবং আমার পরিশ্রমের ফলাফল আমি পেয়েছি। আমি অনেক খুশি। সকলের দোয়া থাকলে ভবিষ্যতে স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো। কিন্তু একটা অন্তরায় হচ্ছে শরীরের যে অবস্থা তার জন্য চিকিৎসা হওয়াটা খুব জরুরি। এভাবে পড়াশোনায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমি যতোটা পড়তে চাই বা পড়ার দরকার ততোটা করতে পারি না। এটা শুধু খারাপ লাগে। আমি ভালো ছাত্রী ছিলাম, এটা ধরে রাখতে পারলে আরও ভালো ফলাফল আসতো। আমার এখন খুব ভয় হয়, আমার স্বপ্ন পূরণের আগেই যেন স্বপ্নটা ভেঙে না যায়।      
আরিফা বলেন, আমার বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হবো। মানুষের সেবা করবো। ছোট থেকে বাবা-মায়ের স্বপ্নটাকে নিজের স্বপ্ন হিসেবে আকড়ে ধরে রেখেছি। লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিলাম। ২০১৯ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলাম। তখনও অনেকটা সুস্থ। এরপর মাঝে-মধ্যে পেটে ব্যথা করতো। ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে এসে এ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা ধরা পড়ে। অপারেশন করার পর ২/৩ মাস ভালো ছিলাম। এরপর শুরু হয় কোমড়ের ব্যথা। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমআরআই করানো হয়েছিল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন muscle spasm রোগে ভুগছি। আমি চলাফেরা করতে পারি না, তেমন বসতেও পারি না। বিছানায় শুয়ে লেখাপড়া করতে হয়। এমনকি শুয়েই খেতে হয়। খুব কষ্ট হয়। যখন কোমড়ে ব্যথা ওঠে সবকিছু যেন কেমন হয়ে যায়। ব্যাথা সহ্য করতে পারি না।
আরিফার চিকিৎসার ব্যয় জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে তার পরিবার। এজন্য চেয়েছেন বৃত্তবানদের সহযোগিতা। তার চিকিৎসার জন্য প্রায় ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। এ ব্যয় তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
আরিফার মা সুলতানা পারভীন বলেন, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। তারা উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যেতে বলেছেন। কিন্তু এই ব্যয় বহন করা আমার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া ও সহযোগিতা প্রার্থনা করছি। আমি যেন মেয়েটির চিকিৎসার জন্য ভারতে নিতে পারি এবং স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে সবাই সেই দোয়া করবেন।
তিনি বলেন, মেয়ে নিজে ভাত খেতে পারে না। পড়তে বসলে তার হাতে কলম ধরে রাখতে পারে না। আমি বই-খাতা ধরে থাকি মেয়ে লেখে-পড়ে। তারপরও যে রেজাল্ট করেছে আলহামদুলিল­াহ। আল­াহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি। এতো অসুস্থতার মধ্যও এসএসসির ফলাফলে জিপিএ ৫ পেয়েছে। শুধু গণিতে ২ মার্কের জন্য গোল্ডেন আসেনি। মেয়ের চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। খুলনা ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে ৯০ হাজার টাকা পেয়েছি। সবাই পাশে থাকলে চিকিৎসার ব্যয় জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাআল­াহ।
নগরীর সরকারি ইকবালনগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি খুবই মেধাবি। অসুস্থ অবস্থায় এসএসসিতে অংশ নিয়েও জিপিএ ৫ পেয়েছে। তার চিকিৎসার প্রয়োজন। চিকিৎসার জন্য অর্থের দরকার। আমরা বিভিন্ন সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তার সহযোগিতার জন্য। আমি প্রত্যাশা করি মেধাবি এই শিক্ষার্থীর জন্য সবাই এগিয়ে আসবে।  
খুলনা ব্লাড ব্যাংকের কোষাধ্যক্ষ আসাদ শেখ বলেন, অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না এমন অনেকেই আমাদের কাছে সহযোগিতার জন্য জানান। আমরা তাদের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে যাচাই করি। যাচাই করে আমরা দেখি আরিফার অবস্থা আসলেই অনেক খারাপ। ছোট্ট একটা মেয়ে যার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, অর্থের অভাবে চিকিৎসা হবে না এটা আসলে মেনে নেওয়া যায় না। আমরা বিষয়টি ফেসবুকের মাধ্যমে পোস্ট করি। প্রায় ৯০ হাজার টাকার মতো সহযোগিতা পায়। কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য প্রায় ৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। আসলে এতোটা আমরা সাড়া পাইনি। সকলের কাছে অনুরোধ রইলো আপনারা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এই ছোট্ট মেয়েটি সুস্থ হয়ে যেতে পারে।
আরিফা জান্নাত আসফিয়াকে সহযোগিতা পাঠানো যাবে- সুলতানা পারভীন, হিসাব নং- ০২০০০১৭৮৬৯৮৫৮, রাউটিং নম্বর- ০১০৪৭০৮২০, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, খুলনা ফরাজীপাড়া শাখা। এছাড়া বিকাশ ও নগদের মাধ্যমেও ০১৭২৪৪৫২১৯৩ সহযোগিতা পাঠানো যাবে।