খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

দক্ষিণাঞ্চলের নিষিদ্ধ চরমপন্থীরা বেশ বদল করে অব্যাহত রেখেছে কন্ট্রাক্ট কিলিং!

সোহাগ দেওয়ান |
০১:০০ এ.এম | ২৪ মে ২০২৪


দক্ষিণ জনপদের এক সময়ের আতঙ্ক নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দল এমএল জনযুদ্ধের সদস্যরা তাদের বেশ ও পরিচয় বদল করে কন্ট্রাক্ট কিলিং অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরাই তাদের প্রধান টার্গেট। এসব হত্যাকান্ডের জন্য তারা কন্ট্রাক্ট প্রদানকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন। সেই টাকা দিয়েই আরাম আয়েশের জীবন, রাজনৈতিক দলে যোগদান, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন। আর নতুন নতুন পরিচয়ে প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে চরমপন্থীরা এ সকল অপরাধের জগত নিয়ন্ত্রণ করছেন। সম্প্রতি ভারতের কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার’র হত্যাকান্ডের পর আবারও জনসম্মুখে আসলো নিষিদ্ধ এ চরমপন্থী দল এমএল জনযুদ্ধের নামটি। 
খুলনা তথা দক্ষিণ জনপদের নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দল এমএল জনযুদ্ধের প্রধান শিমূল ভূঁইয়া। এ অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে হত্যার মাস্টার মাইন্ড তিনি। নিষিদ্ধ ঘোষিত এ সন্ত্রাসী দলটির কার্যক্রম না থাকলেও আঞ্চলিক নেতা শিমূল ভূঁইয়া বেশ বদল করে দলটির কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বছরের পর বছর ধরে সংঘটিত করে রেখেছেন এ সংগঠনের মতাদর্শীদের। টাকার লোভে অনেক ভাড়াটে খুনিরাও তার গ্র“পের কিলিং মিশনে কাজ করছে বলে জানা গেছে। শিমুল ভূঁইয়া তার নাম পরিবর্তন করে আমানুল­াহ নামকরণ করে পাসপোর্ট তৈরি করেন। 
শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে মুক্তা বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য। তার আরেক ভাই শিপলু ভূঁইয়া দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বর্তমান সরকারের আমলেই তারা আ’লীগের রাজনীতিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নতুন করে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। দক্ষিণাঞ্চলে শিমুল ভূঁইয়ার ইশারায় বেশ কিছু রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী হত্যাকান্ডের ঘটনা রয়েছে। তিনি বছরের পর বছর আত্মগোপনে থেকেই কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী নিজের অনুসারী খুনিদের দিয়ে এ সকল হত্যাকান্ডের বাস্তবায়ন করেন।  
তথ্যসূত্রে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুর ২টা দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম থানা পরিষদ চত্বরের একটি সভা শেষে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস কক্ষে যান। এ সময় তৎকালীন ইউএনও মোঃ কামরুল হক ও সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) শের আলী, আটরা গিলাতলা ইউপি চেয়ারম্যান মীর গফফার ও ফুলতলা ইউপি চেয়ারম্যান মন্টু ওই কক্ষে বসা ছিলেন। চেয়ারম্যান কাশেম রুমে ঢোকার পরপরই চরমপন্থি অস্ত্রধারীরা ইউএনও’র কক্ষে ঢুকেই চেয়ারম্যান আবুল কাশেমের মাথায় ও বুকে গুলি চালায়। ঘটনা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তৎকালীন এসিল্যান্ড শের আলী। এরপর সন্ত্রাসীরা চেয়ারম্যান কাশেমের মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আবুল কাশেমের হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফুলতলা উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সহকারী কমিশনার ভূমি (এসিল্যান্ড) তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে পুলিশ প্রহরায় ফুলতলা উপজেলা ত্যাগ করে নিরাপদ হেফাজতে যান। 
এ ঘটনায় ফুলতলা থানায় নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের ছয়জনের নাম উলে­খ করে মামলা দায়ের হয়। একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর কাশেম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আজিম ও মঈন নামের নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের দু’জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। ১৫ সেপ্টেম্বর তারা দু’জন আদালতে এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার ও টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়েছিলো বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। 
এরপর ২০ সেপ্টেম্বর গোপন রাজনৈতিক সংগঠন ইবিসিপি (এমএল) এ হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে বিভিন্ন দপ্তরে লিফলেট বিতরণ করে। পুলিশ তদন্ত শেষে ২০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ১৯৯৯ সালের ৭ জানুয়ারি আদালতে সে চার্জশিট গৃহীত হয়। এরপর আদালতের সব কার্যক্রম শেষে খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০০৯ সালে এ মামলার রায়ে তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। আলোচিত এ মামলার সাজাপ্রাপ্তরা হলেন সেই সময়ের খুলনা বিভাগের চরমপন্থি প্রধান শিমূল ভূঁইয়া, তার ভাই শরীফ আহমেদ শিপলু ভূঁইয়া (বর্তমান দামোদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান) ও মমিনুল ভূঁইয়া। এদের মধ্যে মমিনুল ভূঁইয়া এ হত্যাকান্ডের পর থেকে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলে জানা যায়। তবে উচ্চ আদালত পরবর্তী সময়ে এ মামলা থেকে শিমূল ভূঁইয়া ও শরীফ আহমেদ শিপলু ভূঁইয়াকে অব্যাহতি দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। 
২০১০ সালের ১৬ আগস্ট বেলা পৌনে ১১টার দিকে উপজেলা পরিষদের অদূরে দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের সামনে খুলনা-যশোর মহাসড়কে নিহত সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমের বড় ছেলে ও দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদলকে গুলি করে হত্যা করে চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা। এ সময় ইউপি চেয়ারম্যান তার পরিষদের কাজ সেরে একাই মোটরসাইকেল যোগে বাসায় ফিরছিলেন। হত্যার ঘটনায় নিহতের ছোটভাই সরদার আলাউদ্দিন মিঠু বাদী হয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ নড়াইল জেলা সদরের গোবরা বাজার থেকে জনযুদ্ধ ক্যাডার আল মামুন ওরফে বোমারু মামুনকে গ্রেফতার করে। পরদিন মামুন আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, এ হত্যাকান্ডে তিনি এবং জনযুদ্ধের পিটপিটে সুমন, বিপুল বৈরাগী, রাজুসহ পাঁচজন অংশ নেন। তাদের কারও সঙ্গেই চেয়ারম্যান বাদলের ব্যক্তিগত কোনো শত্র“তা ছিলোনা। টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় তারা এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। মামলাটি পরবর্তিতে সিআইডিতে তদন্তে চলে যায়।  
পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৫শে মে রাতে ফুলতলা উপজেলার নতুন হাট এলাকায় নিজস্ব অফিসে ওই হত্যা মামলার বাদী ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, জেলা বিএনপি’র নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠু ও তার  দেহরক্ষী নওশের আলীকে গুলি করে হত্যা করে চরমপন্থি সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় নিহতের ছোটভাই সরদার রাজ বাদী হয়ে অজ্ঞাত খুনিদের বিরুদ্ধে ফুলতলা থানায় মামলা দায়ের করেন। 
মামলাটির অধিকতর তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইন্সপেক্টর মোঃ শহীদুল­াহ ২০১৯ সালে খুলনা অঞ্চলের শীর্ষ চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়াসহ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হচ্ছে-পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে পিটপিটে সুমন, মোঃ তাইজুল ইসলাম রনি, মুশফিকুর রহমান রিফাত ভূঁইয়া, মোঃ শিমুল হাওলাদার, হাসনাত রিজভি ওরফে মার্শাল ভূঁইয়া, শিমুল ভূঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন ওরফে মুক্তা, রিপন ফকির, বাদল মিয়া ও নিয়ামুল ইসলাম ওরফে শেখ ইমামুল ইসলাম। এ হত্যাকান্ডে লন্ডন প্রবাসী বিএনপি নেতা ড. মামুন রহমানের অর্থায়নের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় থানা পুলিশের প্রথম চার্জশিটে তার নাম উঠে আসে। ড. মামুন রহমান লন্ডনে মারা যাওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আজীম আনারকে ভারতের কলকাতায় খুনের ঘটনায় আবার আলোচনায় উঠে এসেছে শিমুল ভূঁইয়ার নাম। খুলনার নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি সংগঠনের আঞ্চলিক প্রধান শিমুল ভূঁইয়াসহ তার পরিবারের ৪ জনকে আটক করেছে ডিএমপি পুলিশ। তার স্ত্রী সাবিনা মুক্তা, বড় ভাই লাকি ভূঁইয়া ও ভাইপো তানভীর ভূঁইয়াকে এমপি হত্যাকান্ডের ঘটনায় আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 
এ হত্যাকান্ডের অর্থ যোগানদাতা ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিমের ভাই আমেরিকা প্রবাসী আখতারুজ্জামান। চরমপন্থীদের সাথে ৫ কোটি টাকার কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে এমপি আনারকে পরিকল্পিতভাবে ভারতের কলকাতায় নিউ টাউন এলাকায় সঞ্জীভা গার্ডেনসের একটি ফ্লাটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। আমেরিকা প্রবাসী আখতারুজ্জামান এক মাস আগে ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া করেন।