খুলনা | বুধবার | ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | ৭ কার্তিক ১৪৩১

পরীক্ষা চাপ সংক্রান্ত ভীতি ও করণীয়

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী মনোবিজ্ঞানী ও সাইকোথেরাপিস্ট |
১২:১৬ এ.এম | ২৯ জুন ২০২৪


কেস স্ট্যাডি-(১) সাদমান, বয়স-১৪ বছর। বর্তমানে তার সবচেয়ে বড় ভয় ক্লাসের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। পরীক্ষা যখন সমাগত হয়, তখন সে প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্তে¡ও পরীক্ষা সমাগত হলে, সে প্রায় মনে করে-পরীক্ষার কক্ষে সঠিক ভাবে লিখে আসতে ব্যর্থ হবে। সে আরো মনে করে, তার ফেল করার সম্ভাবনা খুব বেশি। 
কেস স্ট্যাডি-(২) প্রিয়াংকা, বয়স-১৮ বছর। পড়াশোনায় বেশ আন্তরিক। কিন্তু  বিপত্তি অন্য জায়গায়। কোন পরীক্ষা এলে তার উদ্বিগ্নতার মাত্রা খুব বেড়ে যায়। পরীক্ষার কয়েক দিন পূর্ব হতে সে ঠিকমত আর টেবিলে পড়তে বসতে পারে না। তার খাওয়া দাওয়া কমে যায়। মেজাজ খিটখিটে দেখা দেয়। কারোর সাথে কথা বলতে চায় না, এমন কি পরিবারের লোকদের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেয়।
উপরের ঘটনা দু’টি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা সংক্রান্তচাপ ও ভীতিকে নির্দেশ করে। পরীক্ষা মানেই একটু বাড়তি চাপ, যার প্রভাব সবার নিকট সমান ভাবে বিরাজমান নয়। ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, পিতা মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক, শিশু বা ব্যক্তির  উপর পরিবেশে ও প্রতিবেশের মনোসামাজিক প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক সক্ষমতার উপর চাপ প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পারে। আর অনেক সময় এরুপ চাপ সমূহের ফলে  তৈরি হতে পারে পরীক্ষার ভীতি।
পরীক্ষা ভীতির শারীর বৃত্তিয় কারণ: শিক্ষার্থী মাত্রই পরীক্ষার সময় স্বাভাবিক ভাবে এক প্রকার মানসিক চাপ অনুভব করে। এই মানসিক চাপ বেশি মাত্রায় অনুভূত হলে ’হাইপোথ্যালামাস’, ’পিটুইটারি গ্রন্থি’ এবং ’এড্রেনাল কটেক্স’ -এই সংগঠনটি একত্রে অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠে। ফলে ব্যক্তি বেশি মাত্রায় নেতিবাচক আবেগীয় অবস্থা অনুভব করে। আবার ব্যক্তি যখন অতি মাত্রায় মানসিক চাপ ব্ধো করে, তখন ব্যক্তির শরীরের অভ্যন্তরে বেশি মাত্রায় ’কর্টিসোল’ নামক হরমোন ক্ষরণ হয়। ফলে ব্যক্তির মধ্যে এক প্রকার ভীতি পরিলক্ষিত হয়। 
পরীক্ষার ভীতির মনস্তাত্তি¡ক ও অন্যান্য কারণ: 
(ক) পরিবেশগত কারণ: (১) পিতা-মাতার কর্তৃক সন্তানের ফলাফল সংক্রান্ত উচ্চাশা। (২) পিতা-মাতা যখন সন্তানের পরীক্ষার ফলাফলকে সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেন। (৩) পিতা মাতা যখন সন্তানকে অন্য শিক্ষার্থীর সাথে প্রায় তুলনা করে থাকেন। (৫) ফলাফল সংক্রান্ত শিক্ষকের বিরুপ মন্তব্য বা শিক্ষক সংক্রান্ত অন্য কোন সমস্যা।(৬) প্রতিবেশ সংক্রান্ত  সমস্যা
(খ) পাঠ সংক্রান্ত সমস্যা: (১) অনিয়মিত পড়া,(২) পরীক্ষার পূর্বে সারা রাত্র জেগে পড়া (৩) ট্রপিক্স এর অর্থ না বুঝে মুখস্ত করা (৪) সঠিক ভাবে রিভাইস না দেওয়া (৫) পড়ার বিষয় মনে করতে ব্যর্থ হওয়া। (৬) রিভাইজিং নোট তৈরি করতে ব্যর্থ হওয়া 
মনোস্তাত্তি¡ক কারণ: (১) পরীক্ষা সংক্রান্ত নেতিবাচক চিন্তা (২) পরীক্ষা সংক্রান্ত আত্মবিশ^াসের অভাব (৩) পরীক্ষা ও ফলাফল সংক্রান্ত অযৌত্তিক চিন্তা (৪) ফলাফলকে মানসম্মানের মানদন্ডে পরিমাপ করা (৫) ১০০% সঠিক ফলাফল প্রাপ্তির আশা নতুবা আমি মূল্যহীন হয়ে পড়বো-এরূপ অযাচিত চিন্তা।
অন্যান্য কারণ:
জনতার ভীতি: অনেক শিশু বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝে কথা বলতে, বসতে, এমন কি লিখতে পর্যন্ত ভয় পায়।
বংশগত কারণ: পূর্বে পিতা মাতার এরূপ ভীতি থেকে থাকলে তবে তাহা সন্তানদের মধ্যে দেখা দিতে পারে। 
পরীক্ষা ভীতির শারীরিক প্রকাশ: (১) পরীক্ষার পূর্বে শিশুর বুক ধরফর করা (২) খাবারে অরুচি দেখা দেওয়া। (৩) পরীক্ষার পূর্বে অনিদ্রা দেখা দেওয়া। (৪) ক্ষেত্র বিশেষ বমি বমি ভাব দেখা দিওয়া (৫) পরীক্ষার সময়ে প্রচুর ঘাম হওয়া। (৭) মনোযোগ সমস্যা দেখা দেওয়া। 
পরীক্ষর ভীতি দূর করতে মা-বাবার করণীয়:
(১) বাসায় পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন: পরীক্ষার সময় শিশুকে একটি কোলাহলমুক্ত পরিবেশ উপহার দেবার চেষ্টা করা; এতে পরীক্ষার্থীর পড়ায় মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে।
(২) পরীক্ষার্থীকে ভাল ভাবে লক্ষ্য করুন: শিশুটির মধ্যে পরীক্ষা ভীতি বিদ্যমান কিনা-তাহা বোঝার জন্য তাকে ভাল ভাবে লক্ষ্য করুন। পেট ব্যথ্যা, বমি বমি ভাব, খাওয়ার অরুচি, ঘুম না আসা,মন ভাল না থাকা, পড়া ভুলে যাওয়া ইত্যাদি বলে দেবে শিশুটি পরীক্ষায় ভীতিতে আক্রান্ত। 
(৩) পরীক্ষার্থীর মনে ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে সহায়তা করুন: ’তুমিও পারবে’-এমন মনোবলযুক্ত একাধিক  উক্তি পরীক্ষার্থীর মানসিক দৃঢ়তা তৈরিপূর্বক পরীক্ষা ভীতিকে দূর করতে যথেষ্ট সহায়ক। 
(৪) পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন: ঘুমের ঘাটতি পরীক্ষার্থীর মনোযোগ বিচ্ছিন্নতার একটি অন্যতম কারণ। সুতরাং প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ হতে ৮ ঘন্ট শিশুর ঘুমের ব্যবস্থা করুন। এতে তার মন শান্ত থাকবে।
(৫) পড়ার মাঝে বিরতি দিন: পরীক্ষার্থীকে পড়ার মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে তার সাথে গল্প করুন-এতে তার মানসিক চাপ কমবে।
পরীক্ষার্থী কতৃক অনুস্মরণীয় : (১) সময়মত রিভাইস দিতে হবে। (২) পরীক্ষার পূর্বে হালকা খাবার খেতে হবে। (৩) রুটিন অনুযায়ী পড়তে হবে। (৪) পড়ার মধ্যে মাঝে মাঝে বিরতী রাখতে হবে। (৫) পরীক্ষার পূর্বের দিন সব কিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। (৬) পরীক্ষার ভীতি সংক্রান্ত বিষয়কে পরিবারের সদস্যদের সাথে বা বন্ধুদের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। 
প্রয়োজনে একজন মনোবিজ্ঞানীর সাহায্য গ্রহণ পূর্বক এ প্রকার সমস্যা হতে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।  
মনস্তাত্তিক কলাম লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা। প্রয়োজনে-০১৭১৪৬১৬০০১।