খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

শ্বশুর ও শাশুড়ির ব্যাংকে ১৯ কোটি টাকা

খুলনায় এনবিআর কর্মকর্তা ফয়সালের বাবার নামে বাড়ি-প্লট

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:৩৯ এ.এম | ৩০ জুন ২০২৪


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা হওয়া এবং পরে তার বড় অংশ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে।
আদালতে জমা দেওয়া দুদকের নথি বলছে, ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর শাশুড়ি মমতাজ বেগম পেশায় গৃহিণী। দুদক বলছে, ফয়সাল ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিজের ও স্ত্রীর নামে রাখার পাশাপাশি স্বজনদের নামেও রেখেছেন। শ্বশুর ও শাশুড়ির নামের ব্যাংক হিসাবে যে অর্থ লেনদেন হয়েছে, তা ফয়সালেরই অপরাধলব্ধ আয়।
দুদকের নথি অনুযায়ী, ফয়সাল ও তাঁর ১১ স্বজনের নামে ১৯টি ব্যাংক ও ১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৮৭টি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাংক হিসাবে। দুদক আদালতে জানিয়েছে, ফয়সাল তাঁর অপরাধলব্ধ আয় লুকানোর জন্য স্বজনদের নামে ৭০০টির মতো ব্যাংক হিসাব খুলেছিলেন। এর মধ্যে দুদক ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়েছে।
অন্যদিকে এনবিআর কর্মকর্তা কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে খুলনায় একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে কয়েক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
আবু মাহমুদ ফয়সালের পৈতৃক বাড়ি নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুজগুন্নী কাজীপাড়া এলাকায়। এখন থাকেন রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে। খুলনাতেও তাঁদের একাধিক বাড়ি, প্লট, দোকান ও জমিজমা আছে।
ফয়সালের স্বজন ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফয়সালের দাদা কাজী রাজ্জাকের পাঁচ ছেলের মধ্যে ফয়সালের বাবা কাজী আবদুল হান্নান (হিরু কাজী) দ্বিতীয়। তাঁদের পরিবার এলাকায় সম্পদশালী হিসেবে পরিচিত। ফয়সালরা দুই ভাই ও এক বোন। ২০০৫ সালে ফয়সাল বিসিএস (কর) ক্যাডারে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগ দেন। এখন তিনি এনবিআরের আয়কর বিভাগের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল এ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট)। ছোট ভাই কাজী খালিদ হাসান জনি ২০০৯ সাল থেকে খুলনায় আইন পেশায় আছেন। ফয়সালের ভগ্নিপতি পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর শ্বশুরবাড়ি নগরের খালিশপুর এলাকায়। স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাইসহ স্বজনদের নামে ফয়সালের সম্পদ আছে বলে জানা গেছে।
দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সালের শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে ১৮টি ব্যাংক হিসাব আছে। এসব ব্যাংক হিসাবে প্রায় ১৯ কোটি টাকা জমা ও পরে এর বড় একটি অংশ উত্তোলনের তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের নথিতে ফয়সাল, তাঁর স্ত্রী আফসানা জেসমিন, ফয়সালের ভাই খালিদ হাসান, শ্বশুর আহম্মেদ আলী, শাশুড়ি মমতাজ বেগম, শ্যালক আফতাব আলী, খালাশাশুড়ি মাহমুদা হাসান, মামাশ্বশুর শেখ নাসির উদ্দিন, আত্মীয় খন্দকার হাফিজুর রহমান, রওশন আরা খাতুন ও ফারহানা আফরোজের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
শনিবার নগরীর খালিশপুরে ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলীর বাড়িতে গিয়ে ফটক বন্ধ দেখা যায়। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে একজন এসে নিজেকে ভাড়াটে পরিচয় দেন। নাম বলেন অগাস্টিন দাস। তিনি বলেন, আহম্মেদ আলীর পরিবার বাড়িটির দোতলা ও তৃতীয় তলায় থাকেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবার ওই বাড়িতে গিয়ে দোতলার সিঁড়ির মুখে ফটক তালাবদ্ধ দেখা গেল। দোরঘণ্টি বাজিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একজন নারী বের হয়ে আসেন। তিনি আহম্মেদ আলীর পুত্রবধূ পরিচয় দেন। ফয়সালের শ্বশুর আহম্মেদ আলী ও শ্যালক আশরাফ আলীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ‘তাঁরা বাড়িতে নেই’ বলে তিনি দরজা বন্ধ করে দেন।
মুজগুন্নী প্রধান সড়কের কাজী বাড়ি এলাকায় ফয়সালের  পৈতৃক বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেলেও কাউকে পাওয়া যায়নি। পাশের বাড়িতে ফয়সালের চাচার পরিবার থাকে। ফয়সালের চাচী নুরুন্নাহার বলেন, ‘২৪ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। আমার বিয়ের পর থেকেই দেখছি, ফয়সালদের পরিবারের সঙ্গে আমার অন্য ভাশুর-দেবরদের তেমন সম্পর্ক নেই। মানে চার ভাই একমতে চললেও ফয়সালদের পরিবার আলাদা। সে জন্য তাঁদের বিষয়ে আমরা তেমন কিছু জানি না। তবে মাঝে মধ্যে তাঁরা এই বাড়িতে এসে ঘুরে যান।’
মুজগুন্নীর ওই বাড়ি ছাড়াও যশোর রোডের পাশে নেছারিয়া মাদ্রাসার উত্তরে ফয়সালদের একটি তিনতলা বাড়ি আছে। সেখানে তাঁর মা ও ভাই থাকেন। বাড়ির নিচতলা ভাড়া দেওয়া। বাড়ির সামনে বড় করে টু-লেট নোটিশ টাঙানো। সেখানে থাকা মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলেও কেউ ধরেননি। বাড়ির ভেতরে গেলে একজন ভাড়াটে জানান, ফয়সালের মা বাড়িতে আছেন। তবে অসুস্থ থাকায় তিনি কারও সঙ্গে দেখা করছেন না।
খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতি থেকে পাওয়া ফয়সালের ভাই কাজী খালিদ হাসানের মুঠোফোন নম্বরে কল দিলেও তিনি ধরেননি।
মুজগুন্নী আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর রোডের শেষ মাথার উল্টো দিকে ফয়সালদের একটি প্লট আছে। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্লটের সামনে বড় একটি ফটক। ফটকের পাশে কাজী আবদুল হান্নানের নামে একটি নামফলক দেওয়া আছে। প্লটে জমির পরিমাণ প্রায় ৪৫ শতক। প্রাচীর ঘেরা জায়গার ভেতরে একটা চায়ের দোকান। দোকানদার শেখ মোহাম্মদ হানিফ প্লটটি দেখভাল করেন। আগে তিনি খুলনা নিউজপ্রিন্ট কারখানায় চাকুরি করতেন।
শেখ মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘নতুন করে তেমন কোনো সম্পদ-সম্পত্তি তিনি (ফয়সাল) করেছেন এ রকম দেখি না। সব তো তাঁর বাপের আমলের। মাঝে মধ্যে এখানে আসেন। ঘুরে চলে চান। গত রমজানের ঈদেও এসেছিলেন। তাঁরা তো লোক খারাপ না বলে জানি।’
ফয়সালের স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফয়সালের মামাবাড়ি নগরের সোনাডাঙ্গার খাঁ বাড়ি এলাকায়। সেখানে তাঁদের জমিজমা আছে। এ ছাড়া খুলনা নিউমার্কেট এলাকায় তাঁদের দোকান আছে। এ ছাড়া বিলে তাঁদের জমিজমা আছে। ফয়সালের সম্পদ জব্দের ঘটনায় এলাকায় কানাঘুষা চলছে।নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহফুজুর রহমান বলেন, ফয়সালের বাবা কাজী আবদুল হান্নান পয়সাওয়ালা লোক ছিলেন। তাঁরা অনেক দিন ধরে মুজগুন্নী কাজীপাড়ার বাড়িতে থাকেন না। নেছারিয়া মাদ্রাসার উত্তর দিকে নতুন বাড়িতে থাকেন। কাজী ফয়সাল এলাকায় কম আসতেন। তবে তার স্ত্রী আফসানা জেসমিন কয়েক দফা তার কাছে সনদ দিতে এসেছেন। এছাড়া প্রায় তিনি টয়েটা ‘হ্যারিয়ার’ গাড়িতে ঘোরাফেরা করতেন।
খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব এড. মোঃ বাবুল হাওলাদার বলেন, এনবিআরের প্রথম সচিব কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বাড়ি খুলনায় হওয়ায় প্রথমে আমাদের গর্ব ছিল। কিন্তু এখন তা আমাদের জন্য লজ্জাকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার এসব দুর্নীতির অর্থের রাজ প্রাসাদের খবর দেখে আমরা বিস্মিত হয়ে পরেছি। সরকারের উচিত এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে অবিলম্বে শাস্তির আওতার আনা।
তিনি আরও বলেন, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি বা অনিয়মে জড়ালে যেসব আইন ও বিধির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সেসব আইন ও বিধি শিথিল করা হয়েছে যে কারণে শাস্তির মাত্র কমে গেছে। এতে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি-অনিয়ম বেড়েছে। তিনি দাবি জানান দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি সরকারের কোষাগারে নিয়ে নেওয়া উচিত।