খুলনা | শুক্রবার | ১৫ অগাস্ট ২০২৫ | ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২

কোটা আন্দোলন : হামলা সংঘর্ষ গুলিতে ৬ জন নিহত

খবর প্রতিবেদন |
০১:২২ এ.এম | ১৭ জুলাই ২০২৪


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে কোটার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সোমবার ছাত্রলীগের হামলার জের ধরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ত্রিমুখী এ সংঘর্ষে মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে অন্তত ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষ থামেনি। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে উত্তেজনা বিরাজ করছে, ঘটেছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। সংঘর্ষে কয়েক শত শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
চলতি মাসের প্রথম থেকে সরকারি চাকুরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এ আন্দোলন করে আসছিল। প্রথমদিকে ঢাকা-জাহাঙ্গীর নগর-চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও চলতি সপ্তাহের শুরুতে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ এবং বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়। 
এর মধ্যে গত রোববার প্রধানমন্ত্রী চীন সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কোটা আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ঘিরে গত রোববার রাতে এবং সোমবার দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। একই সময় ছাত্রলীগও প্রতিবাদ কর্মসূচি দেয়। 
চট্টগ্রাম : কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় কোটা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে এক যুবককে। 
নিহত মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন মোঃ ফারুক (৩২) ও মোঃ ওয়াসিম (২২)। ফারুক ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী এবং ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহŸায়ক বলে জানা গেছে। এছাড়া অপর জনের পরিচয় জানা যায়নি। তাঁর বয়স ২৪। তাঁর পিঠে গুলির চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। অন্যদিকে ফারুকের বুকে গুলি লাগে। আহত অন্তত ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
চট্টগ্রামে নিহত তিনজনই বুকের বাঁ পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ তসলিম উদ্দিন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিকেল ৩টায় চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জড়ো হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হঠাৎ করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের ওপর চড়াও হন। এসময় দুইপক্ষই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা পিছু হটলে শিক্ষার্থীরা এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে নেন।
এদিকে চট্টগ্রামের সংঘর্ষে প্রাথমিকভাবে আহত দু’জনকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁরা মারা যান। অপরজনকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
নিহতদের মধ্যে ফারুকের বাড়ি কুমিল­ায়। তিনি ফার্নিচারের দোকানে চাকুরি করতেন। আর ওয়াসিম আকরাম ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহŸায়ক ছিলেন বলেও নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম বিএনপি’র দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী।
নিহত ফারুক পথচারী ছিলেন বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ তসলিম উদ্দিন। অপর জনের পরিচয় জানাতে পারেননি তিনি।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, হাসপাতাল থেকে আমরা দু’জনের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছি। কোথায়, কীভাবে তারা মারা গেছেন, তা আমরা জানি না। তবে পুলিশ কোথাও বলপ্রয়োগ করেনি।
ওদিকে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিবির ব্যাটালিয়ন-৮ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী।
রাজধানীতে ২ যুবকের মৃত্যু : রাজধানী ঢাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে অন্তত দুইজন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী অজ্ঞাতনামা এক যুবককে গুরুতর অবস্থায় পথচারীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। যুবকের মাথায় জখম ছিল। 
চিকিৎসকের বরাতে ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মোঃ বাচ্চু মিয়া জানান, ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি মর্গে রাখা হয়েছে। তাঁর পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। 
অজ্ঞাতনামা ওই যুবককে হাসপাতালে নিয়ে আসা পথচারী আকাশ জানান, ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে সিএনজি পাম্পের সামনে কয়েকজন ধরাধরি করে ওই যুবককে নিয়ে আসছিল। তখন একটি রিকশায় করে তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়। 
এদিকে রাত ৮টার দিকে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের মাঝে আরও একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা এক অ্যাম্বুলেন্স চালক জানান, ধানমন্ডির সিটি কলেজের পাশে পপুলার হাসপাতালে পৌঁছালে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে অজ্ঞাত ওই যুবককে মাথায় ব্যান্ডেজ অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। যুবকের আঘাতের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 
পুলিশের নিউমার্কেট অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রেফাতুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সায়েন্সল্যাব এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় দুইজন মারা গেছেন।
দুপুর ২টা থেকে ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ চলছে। এর আগে বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনে একদল লোক এক যুবককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন। তাঁকে রক্তাক্ত অবস্থায় বিকেল সোয়া ৫টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আনুমানিক ২৫ বছর বয়সী ওই যুবকের পরিচয়ও জানা যায়নি।
সন্ধ্যায় যাঁর মৃত্যু হয়েছে তাঁর বয়সও ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তিনি আহত অবস্থায় সিটি কলেজের সামনে রাস্তায় পড়ে ছিলেন বলে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, পথচারীরা ওই যুবককে উদ্ধার করে প্রথমে পাশের পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর পরনে ছিল কালো জিন্সের প্যান্ট ও কালো গেঞ্জি।
ওই যুবকের মৃতদেহ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা হয়েছে বলে ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক মোঃ বাচ্চু মিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিহত যুবকের মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
ওই এলাকায় সংঘর্ষের মধ্যে এই দু’জনের মৃত্যু ছাড়াও অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও শতাধিক শিক্ষার্থী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ছাত্র-যুবলীগের অবস্থান থেকে তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে পাঁচ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন।
রংপুর : কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২৫) নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক অবরুদ্ধ করে রাখেন তাঁরা। 
রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদের লাশ নিয়ে বেরোবির দিকে যাত্রা করলে মাঝপথে তাঁদের থামিয়ে দেয় পুলিশ এবং লাশটি তাঁরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। 
জানা গেছে, সংঘর্ষের আগে কোটা আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে অবস্থান নিলে পুলিশ তাঁদের সেখান থেকে সরানোর চেষ্টা করে। পরে আন্দোলনকারীরা পুলিশের বাধা ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ছুড়তে থাকে। এ সময় আন্দোলনকারীরাও ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। এ সময় ১০ সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হন। 
পরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হল থেকে লাঠি, ছোরা, চাপাতিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। একপর্যায়ে শহর থেকে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা যোগ দেন ছাত্রলীগের সঙ্গে। 
পলিটেকনিকের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের হামলায় এক ছাত্র নিহত হয়েছেন। আমাদের ভাইয়ের রক্তের জবাব আমরা দেব।’ 
রমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জানিয়েছেন, হাসপাতালে আনার আগেই ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। 
এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (রাত ৮টা) রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এবং মহাখালীতে থেমে থেমে সংঘর্ষ চলছে।