খুলনা | রবিবার | ১৩ অক্টোবর ২০২৪ | ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

বাগেরহাটে ছাত্র-জনতার দাবির মুখে মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষন কর্মসূচি বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট |
০২:৪০ পি.এম | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪


ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাগেরহাটে জাতীয় মহিলা সংস্থার একটি অংশের প্রশিক্ষন কর্মসূচি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রোববার (০১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে শহরের দশানীস্থ সংস্থাটির জেলা চেয়ারম্যান শরিফা খাতুনের বাড়িতে থাকা প্রশিক্ষন সেন্টারটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বাগেরহাট সদর উপজেলার সহকারি কমিশনার ভূমি এসএম নুরুন্নবী এই আদেশ দেন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেন্টারটির প্রশিক্ষন কর্মসূচি বন্ধ থাকবে।

এর আগে শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করা প্রশিক্ষনার্থী ও স্থানীয়রা জাতীয় মহিলা সংস্থার বাগেরহাটের চেয়ারম্যান শরিফা খাতুনের বাড়িতে থাকা প্রশিক্ষন সেন্টারে যায়। জাতীয় মহিলা সংস্থা বাগেরহাটের চেয়ারম্যানের পদ থেকে শরিফা খাতুনের অপসারণ ও বিভিন্ন সময় করা দূর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার বিচার চান প্রশিক্ষনার্থীরা।

বাগেরহাট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাক এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের স্ত্রী শরিফা খাতুন ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল জাতীয় মহিলা সংস্থা, বাগেরহাটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। এর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিক অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার চরম পর্যায়ে নিয়ে যান তিনি। ক্ষমতাসীন দলের পদে থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা দূর্নীতি করতেন বলে অভিযোগ প্রশিক্ষনার্থীদের।

জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাট শহরের আলী মাদরাসা সড়কে নিজস্ব জমিতে সংস্থাটির কার্যালয় রয়েছে। এই কার্যালয়ের অধীনে রাজস্ব খাতে দর্জি বিজ্ঞান, এ্যাম্বোডারি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষন কোর্স রয়েছে। সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দশানীস্থ এলজিইডি মোড় সংলগ্ন বাড়িতে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনেতিক ক্ষমতায়নে রানী উদ্যোক্তাকে বিকাশ সাধণ প্রকল্পের অধীনে ২ মাস মেয়াদী একটি এবং ৪ মাস মেয়াদী ৪টি কোর্স চালু রয়েছে। কোর্সগুলো হচ্ছে বিউটিফিকেশন, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ও ফ্যাশন ডিজাইন। এই প্রশিক্ষন কর্মসূচি চালু রাখতে একজন প্রশিক্ষন কর্মকর্তা, ৫ জন প্রশিক্ষক ও একজন অফিস সহায়ক রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে এই কোস্ট ৫টিতে প্রতি ব্যাচে দুই শিফটে ৫০ জন করে নারী প্রশিক্ষনের সুযোগ পায়। ২ মাস ব্যাপি কোর্স শেষে ৬ হাজার এবং চার মাস ব্যাপি কোর্স শেষে ১২ হাজার টাকা প্রদান করা হয় প্রশিক্ষনার্থীদের। এছাড়াও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কোর্স পরিচালনা করে আসছেন তিনি। এসব কোর্সে ভর্তি ফ্রী থাকলেও ১০০ থেকে ৬শ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হত। আর সরকারি প্রশিক্ষন ভাতা থেকেও একটা বড় অংকের টাকা নিতেন তিনি। কোন প্রশিক্ষনার্থী কথা বললে তাকে দেওয়া হত ভয়ভীতি।

প্রশিক্ষনার্থীরা জানান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হয়েছেন শরিফা খাতুন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে এমন কোন দূর্নীতি নেই, যা তিনি করেননি। নিজের দলের লোকজনকে প্রশিক্ষনার্থী হিসেবে ভর্তি করানো। ভর্তির জন্য অতিরিক্ত টাকা নেওয়া এবং প্রশিক্ষর্নার্থীদের জন্য সরকারের দেওয়া ভাতা কেটে রাখাসহ নানা অনিয়ম করত। এটা নিয়ে কেউ কথা বললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত।

রুপা নামের এক প্রশিক্ষনার্থী বলেন, এখানে যারা প্রশিক্ষন নিতে আসে তাদের সাথে নানা অনিয়ম করা হয়। প্রশিক্ষনার্থীদের বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হত। সভা সমাবেশে না গেলে বাজে ব্যবহার করতেন চেয়ারম্যান শরিফা খাতুন।

মাওয়া বেগম নামের এক প্রশিক্ষনার্থী বলেন, মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষন কর্মসূচিতে ভর্তির জন্য সরকারি ভাবে কোন ফী নেওয়ার নিয়ম নেই। কিন্তু এখানে ২ মাসের প্রশিক্ষন কর্মসূচিতে ভর্তির জন্য ৩০০ এবং ৪ মাসের প্রশিক্ষনের জন্য ৬শ করে টাকা নেওয়া হত।

আনোয়ারা বেগম নামের আরেক প্রশিক্ষনার্থী বলেন, এখানে মূলত দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষন দেওয়ার কথা থাকলেও, প্রতিটি ব্যাচে বেশিরভাগ প্রশিক্ষনার্থী থাকত শরীফা খাতুনের নিজের লোক ও দলীয় সুপারিশ প্রাপ্ত লোক। এছাড়া প্রশিক্ষন শেষে সরকারিভাবে পাওয়া প্রশিক্ষনার্থীদের ভাতা ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন অজুহাতে কেটে রাখা হত। এগুলো নিয়ে কিছু বলার সুযোগ ছিল না আমাদের।

স্থানীয় বাসিন্দা রুহুল আমিন নামের এক ব্যক্তি বলেন, শরীফা খাতুনের হাত অনেক লম্বা ছিল। এমপিদের সাথে তার সম্পর্ক অনেক ভাল ছিল। তাই তার অপরাধের কথা কেউ কখনও বলতে সাহস পায়নি। তার নিজের দুই মেয়েকে প্রশিক্ষনার্থী সাজিয়েও টাকা নিয়েছেন। এছাড়া প্রতিটি কোর্সে কাগজ-কলমে ৫০ জন থাকলেও, আসলে তা থাকত না। তিনি নিজের অন্তত ৭-৮ লোক দিত প্রতিটি কোর্সে, তাদের পুরো টাকা নিজেই আত্মসাত করত শরিফা খাতুন। নিজ বাড়িতে প্রশিক্ষন কর্মসূচির ভ্যানু নিয়ে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এদিকে জাতীয় মহিলা সংস্থার জেলা কর্মকর্তা মোঃ কাওছারুল হক বলেন, জেলায় আসলে রাজস্ব ও প্রকল্প দুই ধরণের প্রশিক্ষন কার্যক্রম চলত। রাজস্ব খাতের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গুলো প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে আমরা নিয়ন্ত্রণ করি। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে যেসব ট্রেড ছিল, সেগুলো চেয়ারম্যান নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওখানে আমার কোন আর্থিক ক্ষমতাও ছিল না। আর চেয়ারম্যান প্রভাবশালী হওয়ার আমার সাথে কখনও সমন্বয় করতেন না।

এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর গেল ২৯ তারিখ জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ বিলুপ্ত করে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মোহাঃ খালিদ হোসেন বলেন, জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ও প্রশিক্ষন কর্মসূচি নিয়ে বেশকিছু অভিযোগ উঠেছে। সেসব ক্ষতিয়ে দেখা হবে। প্রশিক্ষন কর্মসূচিগুলো যাতে স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন তিনি।

এসব বিষয়ে সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান শরিফা খাতুন বলেন, যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে তাদের লোকজনকেই চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমিও ছিলাম। এখন বাদ দিয়েছে, এটা নিয়ে আমার কোন কথা নেই।