খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৪ আশ্বিন ১৪৩১

খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন প্রকল্পে এখনো অর্থ ছাড় হয়নি, ঠিকাদারও নিয়োগ হয়নি

ভারতীয় ঋণে রেলের ছয় প্রকল্প ১০ বছরে শেষ মাত্র একটিতে

খবর প্রতিবেদন |
০১:২৬ এ.এম | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪


ভারতের ঋণে বাংলাদেশ রেলওয়ের ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে ১০ বছরে মাত্র একটি শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ঋণের অর্থছাড় না হওয়ায় দু’টি এবং দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঠিকাদার ভারতে চলে যাওয়ায় একটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। বাকি দু’টির কাজ শুরু হয়নি। এই পাঁচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন প্রকল্প সংশ্লি¬ষ্ট ব্যক্তিরা। 
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ভারতীয় ঋণ বা লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় রেলের এই ছয় প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো হলো খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প, দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত রেলপথ স্থাপন, বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুনঃস্থাপন, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডাবল লাইন রেলপথ এবং খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন প্রকল্প। 
ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ শেষে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। ২০১০ সালে নেওয়া প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। কাজ শেষের মেয়াদ চার দফা বাড়িয়ে গত বছরের ১ নভেম্বর এই রেলপথের উদ্বোধন হয়। তবে ট্রেন চলে এর সাত মাস পর চলতি বছরের ১ জুন। এই প্রকল্পে খরচ হয় প্রায় ৪ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতের ঋণ ২ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। 
প্রকল্প সংশ্লি¬ষ্ট সূত্র বলছে, এলওসির শর্তে বলা হয়েছে, প্রকল্পগুলোর ৭৫ শতাংশ অর্থায়ন আসবে ভারত থেকে, বাকি ২৫ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ। ভারতীয় ঋণের সব প্রকল্পের অর্থ দেবে দেশটির এক্সিম ব্যাংক। চুক্তি অনুসারে, ৭৫ শতাংশ পণ্য-সেবা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। বাকি ২৫ শতাংশ পণ্য-সেবা ভারতের বাইরে থেকে কেনা যাবে। 
রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্ট দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ভারতের ঋণে রেলের অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রেলের বিভিন্ন প্রকল্প অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। তবে ভারতের ঋণকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজগুলো আবার শুরু হবে। 
ভারতের ঋণের প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী গত মঙ্গলবার বলেন, এসব প্রকল্পের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানানো হয়েছে। সচিব জানিয়েছেন, তাঁরা আলোচনা করে দেখবেন কোন কোন প্রকল্প এমন অবস্থায় রয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পগুলোর বর্তমান অবস্থা জেনে সিদ্ধান্ত নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করা হবে। এরপর হয়তো কোনো সিদ্ধান্ত আসবে। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্রকল্পের কর্মকর্তা বলেন, ঋণের অর্থছাড়ের চিঠি দিলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সময়মতো জবাব দেয় না। অর্থছাড়েও দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। এর বাইরে কাজের প্রতিটি ধাপে অনুমোদনের শর্ত দেয় ভারত। ভারতীয় ঠিকাদার ও পরামর্শক নিয়োগের বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পে অনেক সময় লাগে। 
খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন প্রকল্প : ভারতের ঋণের আওতায় খুলনা থেকে দর্শনা জংশন পর্যন্ত প্রায় ১২৬ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয় ২০২৩ সালে। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। গত এপ্রিল পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ৩ হাজার ৫০৬ কোটি ৭৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকার এই প্রকল্পে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ঋণ ভারতের। তবে এখনো অর্থ ছাড় হয়নি, ঠিকাদারও নিয়োগ হয়নি। 
প্রকল্প পরিচালক মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, তাঁরা ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র আহŸানের জন্য প্রস্তুত। প্রকল্পে ব্যয় কিছু বাড়বে। সার্বিক বিষয়ে ৮ আগস্ট সভা হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। প্রকল্প ব্যয় নতুন করে নির্ধারণ করে ভারতকে জানালে এরপর বোঝা যাবে।
বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ প্রকল্প : ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বগুড়া-সিরাজগঞ্জ ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ আগস্ট। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের জুন। অগ্রগতি না হওয়ায় দুই দফা সময় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পে ভারতের ঋণ ৩ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের ঠিকাদারই নিয়োগ করা হয়নি। কারণ, এলওসির আওতায় হওয়ায় ভারতের ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংক ঠিকাদারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা দিলে দরপত্র আহŸান করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত অক্টোবরে ঠিকাদারদের তালিকা চেয়ে ভারতকে চিঠি দিলেও জবাব আসেনি। 
প্রকল্প পরিচালক মোঃ মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। সব ধরনের কাগজপত্র ভারতের এক্সিম ব্যাংককে পাঠানো আছে। ঋণ ছাড় হলে ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে।
কুলাউড়া-শাহবাজপুর প্রকল্প : ৫১ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন পুনঃস্থাপন প্রকল্প শেষ করার মেয়াদ চতুর্থ দফা বাড়ানো হলেও শেষ হয়নি। এই মেয়াদও শেষ হয় ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তবে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৪৫ শতাংশ। ৬৭৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ভারত ঋণ দেবে ৫৫৬ কোটি টাকা। 
প্রকল্প পরিচালক মোঃ সুলতান আলী বলেন, এই প্রকল্পে এখন বাংলাদেশি শ্রমিকেরা কাজ করছেন। ভারতের কর্মকর্তারা কেউ নেই। আলোচনা করে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। 
ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ ডাবল লাইন : ভারতের ঋণে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান আরেকটি প্রকল্প হলো ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্প। ২০১২ সালে অনুমোদন হয়, প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ করতে লাগে ৬ বছর। কাজের অগ্রগতি ৩৬ শতাংশ। প্রকল্পে ভারতীয় ঋণ ২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ দেবে ৫২১ কোটি টাকা। 
প্রকল্প পরিচালক নাজনীন আরা কেয়া বলেন, ভারতের এক্সিম ব্যাংক এখন অর্থায়ন করবে কি না, এটা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। ঋণ ছাড় চেয়ে এক বছর আগে প্রস্তাব পাঠানো হলেও এখনো উত্তর আসেনি। 
পার্বতীপুর-কাউনিয়া ডুয়েল গেজে রূপান্তর : ভারতের ঋণে দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৭ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েল গেজে রূপান্তর প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হলেও কাজই শুরু হয়নি। চলছে সম্ভাব্যতা যাচাই। এতে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারতের ঋণ ১ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। 
প্রকল্প পরিচালক মোঃ আহসান জাবির বলেন, যেহেতু সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে, তাই নতুন মেয়াদ ঠিক করা হয়নি। 
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ৩০ আগস্ট নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জানান, বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে চলমান প্রকল্পগুলোর কাজ আবার শুরু করবেন। কীভাবে প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়া যায়, বোঝা পড়ার মাধ্যমে তা ঠিক করা হবে। 
সূত্র : আজকের পত্রিকা অনলাইন।