খুলনা | মঙ্গলবার | ১২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৮ কার্তিক ১৪৩১

দ্রুত সংস্কার শেষে ভোটের পক্ষে বামপন্থি দলগুলো, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তাগিদ

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৫ এ.এম | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪


অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের দিকে তাকিয়ে বামপন্থি দলগুলো। বিশেষ করে সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ কোন দিকে মোড় নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় তারা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তাগিদও দিচ্ছে তারা। তবে এই মুহূর্তে সরকারকে তাদের সব কার্যক্রম পরিচালনায় ‘সহযোগিতা করার’ নীতি নিয়েই এগোচ্ছে বামপন্থি এই দলগুলো।
বামপন্থি নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ‘চেতনা’ মেনে সংস্কারের পথেই এগোচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে সংস্কারের জন্য আলাদা ছয়টি কমিশনও গঠন করা হয়েছে, যাদের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম অক্টোবরে শুরু হয়ে তিন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এর পরই রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করার কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।  
তবে সংস্কারের প্রস্তাবনা যাই আসুক, বিশেষ করে সংবিধান, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা এবং আইন ও বিচার বিভাগের সংস্কারের যেসব প্রস্তাবনা আসবে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচিত সরকার ও সংসদের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলেও মনে করছে বাম দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতা ও সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ছাড়া এসব কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে শেষও করতে পারবে না সরকার। সেই বিবেচনায় যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নতুন নির্বাচিত সরকার গঠনের পক্ষে বাম দলগুলো।
এদিকে, সংস্কারের জন্য নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনাও রয়েছে বাম দলগুলোর। এ কারণে সংস্কার-সংক্রান্ত আলাদা প্রস্তাব তৈরি এবং তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুর কথাও জানিয়েছে কয়েকটি বাম দল। শিগগির এমন প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করে বাম প্রগতিশীল ও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর আভাসও দিয়েছেন এসব দলের কয়েকজন নেতা।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম পরিচালনাসহ জাতীয় ইস্যুতে গুরুত্ব কম দেওয়া নিয়ে সরকারের প্রতি ‘কিছুটা ক্ষুব্ধ’ বামপন্থি দলগুলো। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগের পরপরই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে সেনাপ্রধানের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে ডাক পায়নি এসব দল। অবশ্য ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে সিংহভাগ বাম দলকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাম দলগুলো কোনো অনুষ্ঠানেই আমন্ত্রণ পায়নি।
জাতীয় শোক দিবস ও ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি বহাল থাকা-না থাকার প্রশ্নে ১৩ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার মতবিনিময় বৈঠকে আমন্ত্রণ পায় শুধু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) দু-একটি বাম দল। পরে চলতি মাসে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার আরেকটি মতবিনিময় বৈঠকে ডাকা হয় বাংলাদেশ জাসদ ও অন্য বাম দলগুলোকে, যারা আবার আগের মতবিনিময়ে আমন্ত্রণ পায়নি। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাম দলগুলোর প্রতি সরকারের এমন ‘বৈষম্যমূলক আচরণ’ নিয়ে তখনই পৃথক বিবৃতি দিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল বাম দলগুলো। এর পরও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সফলতার দিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য পূরণেই তারা এ সরকারের সব কার্যক্রমে সক্রিয় সমর্থন দেবেন বলেই দাবি বামপন্থি নেতাদের।          
এর আগে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। মূলত শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে এই গণঅভ্যুত্থান ঘটলেও ছাত্র-জনতার ওই আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের পাশাপাশি আওয়ামী লীগবিরোধী বাম দলগুলোও সর্বাত্মক সমর্থন ও সক্রিয় অংশ নিয়েছে।
অবশ্য শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরুর অনেক আগে থেকেই তৎকালীন সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে ছিল দেশের অন্যতম প্রধান বামপন্থি জোট সিপিবি, বাসদসহ ছয়টি বাম দল নিয়ে গঠিত ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’, বাংলাদেশ জাসদ এবং অন্য ছোট চারটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত আরেক জোট ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা’। জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলসহ আরও কিছু বাম দল নিজেদের মতো করে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী অবস্থান নিয়ে সক্রিয় ছিল রাজপথে।    
আরেক দিকে, গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক হিসেবে যুক্ত থাকা গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্ল¬বী ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্য বাম দলগুলো এবং অন্য পাঁচটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য’কে বিএনপি ও তার মিত্র জোটগুলোর সঙ্গে সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় দেখা যায়। এই অংশের বাম দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের বছর দুয়েক আগে থেকেই ৩১ দফার ভিত্তিতে বিএনপি’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নামে।    
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ বিরোধী এসব বাম দল এখন ‘দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ প্রয়োজনে বিএনপি’র সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা এবং রাজনৈতিক মতবিনিময়ের কথাও ভাবছে। তাদের মতে, সা¤প্রতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যারা সক্রিয় ছিল, তাদের সবার সঙ্গেই পারস্পরিক যোগাযোগ থাকা উচিত। একই মত ও পথের রাজনৈতিক দলগুলো জরুরি ও ন্যূনতম ইস্যুতে একসঙ্গে পথ না চললে ফ্যাসিবাদী শক্তি আবারও মাথা চাড়া দিতে পারে, যা গণআন্দোলনের চেতনাকে নস্যাৎ করতে পারে বলেও তাদের শঙ্কা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া সমকালকে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের সমর্থন থাকবে। দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে আমরা সরকারের সব কার্যক্রমে সহযোগিতাও করতে চাই। তবে আমরা মনে করি, সংস্কার প্রশ্নে সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া এবং ন্যূনতম ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো। এর পর নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে বাকি কাজগুলো ছেড়ে দেওয়া উচিত।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, মনে রাখা দরকার-এই সরকার হচ্ছে একটা অন্তর্বর্তী সরকার, নিয়মিত সরকার নয়। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সংস্কার বিষয়ে কী কী করা দরকার, তারা সেটা দ্রুততার সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি- পেশার প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্ধারণ করবে। কিছু কাজ পারলে শুরু করবে, বাকি কাজগুলো নির্বাচিত সরকারের জন্য রাখতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করেই নির্বাচনের কাজটা শুরু করতে হবে। সরকার এ ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত।     
বিপ্ল¬বী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সক্রিয় অংশীদার হিসেবেই আমরা রাজনৈতিক ও নৈতিক দিক থেকে এ সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি। আমরা চাই, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ জরুরি সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা নেবে। সরকার যেন সঠিক পথে থেকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে পারে, সেটাই আমরা আশা করি।    
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত এই অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা সহযোগিতা করবো। তবে আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক সংস্কার শেষে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তার মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারই নতুন সংবিধান প্রণয়নসহ রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার কাজগুলো শেষ করে জনআকাক্সক্ষা পূরণ করবে।