খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

খুলনায় দারোয়ান থেকে কোটিপতি রমজান (পর্ব-২)

মাদক-অস্ত্রের সম্রাজ্য গড়েছে রমজান ও তার পরিবার ভাড়াটে খুনি হিসেবে চিহ্নিত ভাগ্নে আশিক-সজিব গ্যাং

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০১:২৯ এ.এম | ০৯ অক্টোবর ২০২৪


বহুদিন ধরেই খুলনার রূপসা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব গড়েছে রমজান আলী হাওলাদার ও তার পরিবার। আ’লীগের পদকে হাতিয়ার বানিয়ে মাদক ও অস্ত্রের সরবরাহকারী বনে যায় তারা। দুই যুগ আগে প্রথমে দারোয়ানের চাকুরি থেকে শুরু রমজানের জীবন। পরে জমি দখল, ডাকাতি, মাদক ও অস্ত্রের সরবরাহ করার মাধ্যমে মালিক হয়েছে কোটি টাকার। 
জানা যায়, রমজান আলীর নামে বাগেরহাটে ৩টি খুনের মামলা রয়েছে। যার প্রধান আসামি সে। তার সকল কর্মকান্ডকে মদদ দেওয়া ও প্রশাসনের হাত থেকে বাঁচানোর কাজটা সারতেন সাবেক সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকসহ প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায়।  
রমজানের সাথে রাজত্ব গড়েছে তার ভাই খেলাফত। রূপসা এলাকায় সব ধরনের চাঁদাবাজির শীর্ষে সে। কুলি থেকে শুরু করে স্থানীয় ব্যবসায়ী সবার কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে খেলাফত। অবৈধ ভাবে আয় করেছে কোটি কোটি টাকা। রূপসা ঘাটের পার্কের পাশে একটি বিল্ডিং বানিয়ে সব ধরনের অবৈধ কর্মকান্ড চালাতো সে। বিভিন্ন ধরনের মানুষকে অপহরণ করে সেখানে এনে নির্যাতন করে চাঁদা দাবি করা হতো। এছাড়াও নারীদের ধরে এনে পার্কের মধ্যেই গণধর্ষণ করতো খেলাফত ও তার সহযোগীরা। কিছুদিন আগেই রূপসার বিআরটিএ কাউন্টারের পরিচালককে অস্ত্র দেখিয়ে দখল করে নেয় কাউন্টার। খেলাফত খুলনা শহরে বিভিন্ন মেয়াদে ভাড়া দিতো আগ্নেয় অস্ত্র। এছাড়াও নারী ধর্ষণ, হিরোইনের ব্যবসা, খুনের সাথে জড়িত থাকা সহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে খেলাফতের বিরুদ্ধে। এই খেলাফতের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় রয়েছে একাধিক মামলা। 
একই পথের পথিক রমজান ও খেলাফতের বোন জুলেখা। জুলেখার প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পায়নি তার স্বামী জলদস্যু নেতা জুলফিকার। টাকার লোভে স্বামীকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়ে পালায় সে। সাংবাদিক মহসীন উল হাকিমের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, সেই সময় পূর্বদিকের ত্রাস ছিল জুলফিকারের অনুগামীরা। সুন্দরবনের মাছ ধরার মূল জায়গা কিন্তু পশুর নদীর পূর্বদিক। দুবলার চর থেকে শুরু করে একেবারে বঙ্গোপসাগর বিরাট এলাকা জুড়ে ডাকাতি করতো জুলফিকার। সুন্দরবনের বেশির ভাগ মাছ ব্যবসায়ীদের নিয়ে তার কারবার। খুলনার মাছচক্রের গডফাদাররা ছিল জুলফিকারের মূল সহযোগী। বিশেষ করে তার স্ত্রী জুলেখার ভাই রমজান ও খেলাফত ছিলো তার মূল সহযোগী। এর ফলে অস্ত্র-শস্ত্র, কাঁচা টাকা সংগ্রহের যে লাইন, জুলফিকার সেটা একেবারে পাকাপোক্তভাবে করতে পেরেছিল। অল্পদিনের মধ্যেই জুলফিকার বাহিনী একটি বড় বাহিনীতে পরিণত  হয়। জুলফিকার কোটি কোটি টাকার মালিক ছিলো। জুলফিকার সেই টাকা নিয়ে কিছুদিনের জন্য সুন্দরবন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। জুলফিকার সেই সময় দস্যুবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল। কথাটি সে তার স্ত্রী জুলেখাকে জানিয়েছিল। সেই সময় জুলেখা তাকে তার বাড়িতে আসতে বলে। পরে জঙ্গল পেরিয়ে খুলনায় তার স্ত্রীর বাড়িতে যায় সে।  
জানা যায় সেই সময় জুলফিকারের কাছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ছিল। জুলফিকার ওই টাকাটা এনে স্ত্রীর হাতে দেয়। তার কিছু পরে ওখানে হাজির হয় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। গোটা বাড়ি ঘিরে ফেলে তারা। শোনা যায়, জুলফিকারকে খুলনার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কয়েকদিন পরে খবর মেলে, ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছে জুলফিকার। তারপর জুলফিকারের সব নগদ টাকা ও ডাকাতি করে আনা স্বর্ণালঙ্কার আত্মসাৎ করে জুলেখা। জুলফিকার বাহিনীর ব্যবহার করা বেশ কিছু অস্ত্রও হাতিয়ে নেয় সে। পরে তা খুনের কাজে ভাড়া দেয় বলে জানা গেছে। জুলেখার একাধিক স্বামী রয়েছে বলে জানা যায়। 
এখানেই থেমে নেই। রমজান, খেলাফত, জুলেখাদের পরবর্তী প্রজন্মও চলছে একই পথে। নগরীর রূপসা এলাকায় একটি ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং গড়ে তুলেছে জুলেখার ছেলে সজিব ও আশিক। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে দেশি-বিদেশী অস্ত্র, মাদক সেবন এবং ব্যবসা, খুন-অপহরণসহ বেশ কিছু অভিযোগ। এলাকার তরুণ যুবকদের টাকা ও মাদক দিয়ে কিশোর গ্যাং এ লিপ্ত করে এই সজিব ও আশিক। এছাড়াও রূপসাসহ খুলনার বেশিরভাগ এলাকায় তরুণ সমাজের হাতে মাদক তুলে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে এই দুই যুবক। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। তবে প্রশ্ন হলো এদের মদদ দাতা কে? গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার প্রচুর পরিমাণ মাদকসহ গ্রেফতার হলেও সেই মামলায় মাত্র ১০-১২ দিনের মধ্যে বের হয়ে আসে এই সজিব-আশিক গ্যাং এর সদস্যরা। আবারো শুরু করে একই কাজ। এই গ্যাং এর সদস্যরা লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ব্যবহার করে নানা অপকর্মের জন্য। এছাড়াও দেশি-বিদেশী বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র তাদেরকে সরবরাহ করছে এই নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন। 
এরই মধ্যে গত ৭ অক্টোবর নৌ-বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ বাহিনীর অভিযানে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও ইয়াবা সম্রাট সজীবসহ ৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এরা সবাই কিশোর গ্যাং আশিক গ্রæপের সদস্য। এ সময় তাদের দেওয়া তথ্য মতে, তার বাসা থেকে ১৬১৭ পিস ইয়াবা, এক লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার টাকা, ২১টি মোবাইল সেট, ১টি ল্যাপটপ, ৫টি সিসি ক্যামেরা ও ১টি রাম দা উদ্ধার করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে রমজান ও তার পরিবারের সদস্যদের কারণে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতে ভয় পেয়েছে সাধারণ মানুষ। এলাকার বেশির ভাগ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা নিয়েছে চাঁদা। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ এদের কাছে ছিলো ছোটখাটো বিষয়। এছাড়াও এলাকায় মাদক ও অস্ত্র দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে নষ্ট করেছে এরা। তাই এদের কঠিন বিচারের দাবি জানান স্থানীরা। এছাড়াও তারা যেন কোনো প্রভাব খাটিয়ে দ্রুত আইনের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে বেরিয়ে আসতে না পারে সে ব্যাপারে নজর রাখার দাবি তাদের।