খুলনা | সোমবার | ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

চর দখলে কতিপয় ইটভাটা মালিক

হুমকির মুখে রূপসার শ্রীরামপুরে বিলে আটশ’ মিটার ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ

আল মাহমুদ প্রিন্স |
০১:২৫ এ.এম | ১০ অক্টোবর ২০২৪


খুলনার আঠারোবেঁকী নদীর কোল ঘেঁষে রূপসার বিল শ্রীরামপুর গ্রামের আটশ’ মিটার ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। কতিপয় ইটভাটা মালিকের চর দখলের কারণে বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁক সৃষ্টি হয়েছে। আর এ বাঁকের কারণে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে নদী প্রবাহের গতিধারা। জোয়ারের সময় প্রবল স্রোতের কারণে নদীর বিপরীতে পাড়ে ভেড়িবাঁধে লেগেছে বড় ধরনের ভাঙ্গন। এলাকার সচেতন মহলের দাবি ভেড়িবাঁধটি ভাঙন রোধকল্পে বাঁক কেটে উন্মুক্ত করতে ড্রেজার দিয়ে নদী খননের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।    
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, রূপসা উপজেলার শ্রীরামপুর, নেহালপুর, কিসমত খুলনা, নৈহাটী, চর-শ্রীরামপুর গ্রামের চার শতাধিক কৃষক চাষাবাদ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলে এমনকি জোয়ারে যখন পানির চাপ বেড়ে যায় তখন শ্রীরামপুর পালপাড়া ও মালোপাড়া হতে মেসার্স এনবিআই ইটের ভাটা পর্যন্ত প্রায় আটশ’ মিটার ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভাঙনের কবলে পড়তে হয়। ভুক্তভোগী কৃষক ও এলাকাবাসীর অভিযোগ শ্রীফলতলা ইউনিয়নের ভদ্রাগাতি গ্রামের কোল ঘেঁষে আঠারোবেঁকী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এফবিএম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী নদীখেকো কাজী বেলায়েত হোসেন বিকু, মেসার্স টাটা ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী সালাম জমাদ্দার ও ইটের ভাটার ইসহাক সরদার প্রায় একযুগ ধরে নদীর চর দখল করে আসছে। নদীখেকো গং প্রতিবছর নদীর চরে ইটপাটকেল ফেলে ইটভাটার জায়গা বাড়িয়ে আসছে। চর দখল করার কারণে বর্তমানে বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁকে পরিণত হওয়ায় নদী প্রবাহের গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এতে জোয়ারের সময় পানি যখন বাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন নদীর বিপরীত পাড়ে মারাত্মক পানির চাপ সৃষ্টি হয়। 
২০২২ সালে যখন ভাঙ্গন রোধে কৃষকদের চাপের মুখে এফবিএম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী কাজী বেলায়েত হোসেন বিকু, মেসার্স টাটা ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী সালাম জমাদ্দার ও ইটভাটা মালিক ইসহাক সরদারের ভাটার সামনে নদীর চরে বাঁক কেটে দেওয়ার জন্য সরকারি ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শ্রীরামপুর বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড সদস্যদের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বিশাল দীর্ঘ বাঁকটি কেটে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য নদী খনন কাজ শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে খনন কাজটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি, বেসরকারি ভাবে দুই কোটি টাকা ব্যয় করেও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়নি। ভেড়িবাঁধ সংস্করের জন্য শ্রীরামপুর বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ১১ লক্ষধিক টাকা ব্যয় করা হয়েছে। 
এদিকে বাঁকটি থাকার কারণে নদীর বিপরীত পাড়ে এমআরবি ব্রিকসের ৭/৮ বিঘে জায়গাসহ বেশ কয়েকটি বসতঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শ্রীরামপুর পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের ভেড়িবাঁধ এখন চরম হুমকির মুখে। ভেড়িবাঁধটি ভেঙে গেলে যেকোনো সময় ৩৮২ হেক্টর তিন ফসলি জমির আবাদ প্লাবিত হয়ে যাবে। 
এফবিএম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী কাজী বেলায়েত হোসেন বিকু দৈনিক সময়ের খবরকে বলেন, ‘আঠারোবেঁকী নদীর চরে বাঁকটি কেটে না দিলে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে না। স্থায়ী ভাবে সমস্যা সমাধান করতে হলে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ড্রেজার মেশিন দ্বারা নদী খননের পাশাপাশি বাঁকটি কেটে উন্মুুক্ত দিলে নদী প্রবাহের গতিধারা ফিরে পাবে। এতে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধটি ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।’ 
শ্রীরামপুর বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোমরেজ আলী বলেন, ‘কতিপয় নদীখেকো ইটভাটা মালিকের কারণে নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এফবিএম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী কাজী বেলায়েত হোসেন বিকু, মেসার্স টাটা ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী সালাম জমাদ্দার ও নন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা ইটভাটা মালিক ইসহাক সরদার নদীর চর দখল করতে করতে এখন বিশাল এলাকা জুড়ে বড় ধরনের বাঁকে পরিণত হয়েছে। জোয়ারের সময় পানি যখন বাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন নদীর বিপরীত পাড়ে পানির চাপে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, ড্রেজার দিয়ে বাঁকটি খনন করে দিলে ভেড়িবাঁধসহ নদী পাড়ে বসতঘরগুলোও স্থায়ীভাবে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।’ 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ইলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ ফাহাদ গাজী বলেন, ‘কতিপয় ব্যবসায়ীর নদীর চর দখলের কারণে সেখানে বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁকে পরিণত হয়। তিনি বলেন, এলাকাবাসী ও কৃষকদের স্বার্থে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নদীর তীরে গড়ে তোলা বিশাল বাঁকটি কেটে উন্মুক্ত করা প্রয়োজন। তাহলে বিল শ্রীরামপুরে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধটি ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পাবে।’
শ্রীরামপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মোঃ সাব্বির শেখ বলেন, ‘কয়েকজন ভাটা মালিক আঠারোবেঁকী নদীর চরে প্রতিবছর ইটপাটকেল ফেলে চর দখল করে আসছে। চর দখল করায় বিশাল এলাকা জুড়ে বড় ধরনের বাঁক সৃষ্টি হওয়ায় নদী প্রবাহের গতিধারা রোধ করা হয়েছে। ফলে জোয়ারের সময় প্রবল স্রোত বাঁকের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়ে বিপরীত পাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া শ্রীরামপুর বিলের ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। এজন্য বাঁকটি ড্রেজার দিয়ে কেটে উন্মুক্ত করা হলে নদী যেমন ফিরে পাবে গতিপথ, অন্যদিকে কৃষকরা রক্ষা পাবে ভেড়িবাঁধ ভাঙনের কবল থেকে।’ 
শ্রীরামপুর বিল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য মোঃ দাউদ আলী শেখ বলেন, ‘সরকারি বেসরকারি ভাবে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করেও  কোনো কাজে আসেনি। ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভাঙন রোধ করতে ড্রেজার দিয়ে নদীর তীরে গড়ে তোলা বাঁকটি কেটে দিতে হবে। এজন্য সরকারি ভাবে বরাদ্দের প্রয়োজন।’ 
ভুক্তভোগী শ্রীরামপুর গ্রামের মালোপাড়ার জেলে অসিত বিশ্বাস বলেন, ‘কিছু ইটভাটা মালিক নদীর চর দখল করায় বিশাল এলাকাজুড়ে বাঁক সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য নদীর পাড়ও ভেঙে যাচ্ছে। এতে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধটি হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁকটি দ্রুত কেটে ফেলা দরকার। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কয়েকটি বসতঘরসহ এমআরবি ব্রিকস এর ৭/৮ বিঘে জমি নদীর মধ্যে চলে গেছে।’ মালোপাড়া এলাকার বাসিন্দা মৎস্যজীবী গিরিশ বিশ্বাস বলেন, ‘ভাঙন রোধে ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করার সময় বাঁক কেটে দিলে নদীর গতিপথ ফিরে পাবে। এতে ওয়াপদা ভেড়িবাঁধ ভাঙন থেকে রোধ পাবে।’