খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নির্যাতিত ছিল মানুষ, রয়েছে দখলসহ নানা অভিযোগ

ডুমুরিয়া-ফুলতলা এলাকায় একক আধিপত্যে ছিলেন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ

এন আই রকি |
০১:১১ এ.এম | ১২ অক্টোবর ২০২৪


খুলনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের একক প্রভাব ছিল এলাকায়। সাবেক ভূমি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে নারী অপহরণ মামলা, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পরিবারের সাথে সখ্যতা, হলফনামায় সম্পদের ছলচাতুরি, নদী দখলসহ তার এলাকায় সরকারি জমি দখল করে জমির ব্যবসা পরিচালনায় সহায়তাসহ রয়েছে নানান অভিযোগ। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছিল সাবেক এই মন্ত্রী। গত ৬ অক্টোবর অবৈধভাবে ভারতে পালানোর সময় ঝিনাহদহের মহেশপুর সীমান্তে বিজিপির হাতে আটক হয়েছেন। কিন্তু এখনও তার সহযোগীরা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আসনটিতে সনাতন ধর্মালম্বীদের বসবাস বেশি থাকায় এবং আওয়ামী লীগের দলের মধ্যে বিভেদ থাকার কারণে এখনও সাবেক এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি আসনটিতে এক সময় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবেও পরিচিত ছিল। নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিষ্ট পার্টিসহ অনেক নিষিদ্ধ দলের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল এই এলাকাটি। এসব সন্ত্রাসীদের পরিবারের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল সাবেক এই মন্ত্রীর।  
অনুসন্ধানে জানা যায়,  ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-৫ আসন। শিক্ষকতা জীবন থেকে কর্মজীবন শুরু করলে ১৯৬৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন।  তিনি ২০০০ সালে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালসহ মোট পাঁচবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থেকে মন্ত্রী এবং সর্বশেষ ভূমিমন্ত্রীরও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার স্ত্রী উষা রানী চন্দ্র ডুমুরিয়ার একটি সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বড় ছেলে বিশ্বজিৎ চন্দ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং সাবেক ইউজিসির সদস্য ছিলেন। অপর ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র স্থানীয় সার ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। খুলনা জেলা পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান ছিল তার প্রয়াত ছেলে অভিজিৎ চন্দ্র। তার একমাত্র মেয়ের অপমৃত্যু হয়েছিল বলে এলাকায় গুঞ্জন আছে। তার জামাতা বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। 
আরও জানা যায়, ডুমুরিয়ার ভদ্রা নদীর তীরে নদীর জমি দখল করে কেপিবি ব্রীক নামে একটি ইট ভাটা করেছিলেন নারায়ণ চন্দ্রের। ভাটাটির অবৈধতা নিয়ে মিডিয়ায় অনেক সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর গত বছর সেটি গুটিয়ে ফেলা হয়। উলে­খ্য যে ২০২১ সালে ডুমুরিয়ার ভদ্রাদিয়া গ্রামের ১১ জনের প্রায় ১০০ বিঘা জমি দখল করে সেখানে ইটভাটা তৈরি করার অভিযোগে নারায়ণ চন্দ্র এবং তাঁর দুই ছেলে সত্যজিৎ চন্দ্র, বিশ্বজিৎ চন্দ্রসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে গত ১৫ সেপ্টেম্বর খুলনার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন ওই গ্রামের বীরেশ্বর মলি­ক।
এরপর তিনি একই নামে আরও একটি ইটভাটা করেন। সেখানেও সরকারি খাস জমি দখলের অভিযোগসহ সরকারি টাকায় ইট ভাটা পর্যন্ত রাস্তা নেওয়ার অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা জানান, ইট ভাটার কারণে রাস্তা করা হয়েছে। পাশাপাশি ইট ভাটার কারণে আশেপাশের ফসলী জমিতে আর ফলন না হওয়ায় এলাকাবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। খর্নিয়া বাজারের মাদ্রাসার পাশেই নারায়ণ চন্দ্রের নির্দেশে একটি মিল দখল করা হয়েছিল ২০১৫ সালে। মিলটি ছিল তৎকালীন এক বিএনপি নেতার। এছাড়া গুটুদিয়া এলাকায় সরকারি খাস জমি দখল করে প্লট ব্যবসা করতেন নারায়ণ চন্দ্রের সাথে থাকা একাধিক আওয়ামী লীগ নেতারা। তিনি ভূমিমন্ত্রী থাকার পরও এমন অপকর্মের বিষয়ে তেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 
সাবেক এই মন্ত্রীর ডুমুরিয়ার উলা গ্রামে একটি বাড়িসহ সদরে রয়েছে দ্বিতলা বিশিষ্ট আরেকটি বাড়ি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্ধকোটি টাকার সঞ্চয়পত্রসহ রয়েছে দু’টি গাড়ি।  নিজ ও স্ত্রীর নামে আছে কয়েক প্রায় ৮ একর জমি। এদিকে চরমপন্থি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) খুলনা বিভাগীয় সম্পাদক শিমুল ভূঁইয়ার ভাই শিপলু ভূঁইয়ার সঙ্গে নারায়ণ চন্দ্রের ঘনিষ্ঠতা ছিল। নারায়ণ চন্দ্রের হাতে ফুল দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন শিপলু ভূঁইয়া। এরপর তিনি দুইবার নৌকা প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচিত হন। এছাড়া শিপলু ভুঁইয়ার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন মুক্তা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় খুলনা জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।  
দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী থাকার কারণে এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি যারা করতেন তারা নানান ভাবে হামলা ও মামলার স্বীকার হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় নিজ দলের কেউ প্রতিবাদ করলেও তাকে নানান ভাবে হয়রানি করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব কাজে নারায়ণ চন্দ্রকে সহযোগিতা করতেন  সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগীতা করতেন তার এপিএস সমীর দে গোরা, ইউপি সদস্য সঞ্জয় মলি­ক, ইউপি চেয়ারম্যান গোপাল দে, সুরঞ্জিত বৌদ্ধ, তৌহিদুজ্জামান  এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ। 
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরও আয় বাড়েনি সাবেক এই মন্ত্রীর। এমনভাবেই তিনি সর্বশেষ নির্বাচনের সময় হলফনামা দাখিল করেছেন। তার দু’টি হলফনামা যাচাই করে দেখা গেছে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বার্ষিক আয় কমেছে। যা একধরণের ছলচাতুরির কৌশল। ২০১৮ সালে হলফনামায় তাঁর বার্ষিক আয় দেখান ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। সম্পদ ছিল ৬৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার। ২০২৪ সালে দেওয়া হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৭ লাখ টাকায়। সম্পদের মধ্যে ব্যাংকে জমা ৫৫ লাখ টাকা, ৪ দশমিক ১৭ একর কৃষিজমি, কিছু অকৃষি জমি, একটি দালান ও একটি সেমিপাকা ভবন রয়েছে। ব্যাংকে তাঁর ঋণ ১ কোটি ৯৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। এসবের বাইরে তার বেনামে এবং নামে বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণ চন্দ্র চন্দসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে অপহরণের মামলা করেন এক তরুণী। ঐ তরুণী অভিযোগ করেন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। নারায়ণ চন্দ্রের এক ঘনিষ্ঠজনই এই অপকর্মের সাথে জড়িত। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তার নির্দেশে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। এছাড়া নারায়ণ চন্দ্রের কথা না শুনলেই মামলার পাশাপাশি তার পিএস সমীর দে গোরার বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।  
ডুমুরিয়ার গুটুদিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শেখ তুহিনুল ইসলাম তুহিন বলেন ভূমিমন্ত্রী থাকার পরও অত্র এলাকায় বিশ্বাস প্রোপার্টিজ, তানিশা প্রোপার্টিজ, বিসমিল­াহ প্রোপার্টিজ প্রকল্পসহ একাধিক বিভিন্ন প্রোপার্টিজের মালিকরা খাল এবং খাস জমি দখল করে ব্যবসা করেছে।  এতে সাধারণ মানুষ অনেক ভোগান্তিতে পড়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা বিএনপি নেতা মোশাররফ হোসেন মফিজ জানান, নারায়ণ চন্দ্র চন্দের আমালে ভোট ডাকাতিসহ সকল ক্ষেত্রেই তার আধিপত্য ছিল। তার কাছের লোকজন খাল বিল দখল করেছে। চাকুরির ক্ষেত্রে কাছের লোক ছাড়া কেউই পায়নি। হামলা ও মামলা দিয়ে রাজনীতি করতে দেয়নি।