খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

পীড়ন বা স্ট্রেস ও শারীরিক ব্যাধি

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
০১:৪২ এ.এম | ১৯ অক্টোবর ২০২৪


লোপা খানম (ছদ্ম নাম) বয়স ৩৬ বছর। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ৯ বছর যাবৎ চাকুরি করছেন। স¤প্রতি তিনি জানতে পেরেছেন-তিন মাস পর তার কোম্পানি বন্ধ হতে চলেছে। খবরটা জানতে পেরে তিনি এক প্রকার কঠিন পীড়নের সম্মুখীন হলেন। উলে­খ কোম্পানি বন্ধ হওয়ার এ খবরটি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার তেমন কোন প্রকার শারীরিক সমস্যা ছিল না। কিন্তু খবরটি জানার পর হতে তার বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগীয় মানসিক সমস্যা (যেমন- উদ্বিগ্নতা, পীড়ন, ভয় ও ক্রোধ) দেখা দিতে লাগলো। এখন তার রক্তচাপ প্রায় সময় উর্দ্ধমুখি থাকে। ডাক্তার বলেছেন পীড়নের কারণে তার রক্তচাপে গোলমাল দেখা দিয়েছে। তিনি এখন আর কোন কাজ মনোযোগ সহকারে করতে ব্যর্থ হন। ইদানিং তিনি ছোট খাট ব্যাপারকে কেন্দ্র করে প্রায়শঃ রাগ প্রকাশ করে থাকেন। বর্তমানে তার  রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণের জন্য উচ্চ মাত্রার ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রক ঔষধ খেতে হয়।  
নিনা খানম (ছদ্ম নাম) বয়স-৩৩ বছর। ভুল বোঝাবুঝিকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্ব›দ্ব এখন তাদের চরমে। ইদার্নিং নিনার পেটের পীড়ার বড় রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার পর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিনার কোন শারীরিক রোগ খুঁজে পেলো না। বরং ডাক্তার সাহেব শুধু এতটুকুই বললেন; আপনার কোন মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেওয়া উচিত যিনি আপনার এ রোগের সমাধান দিতে পারবেন। ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী শরণাপন্ন হলেন। মনোবিজ্ঞানী সাহেব তার আদ্যোপান্ত শ্রবণ করে এবং কয়েকটি মনস্তাত্তি¡ক পরীক্ষা মূল্যায়নের মাধ্যমে নির্ণয় করলেন যে, আসলে লীনা বর্তমানে এক প্রকার মানসিক চাপ তথা পীড়নমূলক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।  ফলে তার পেটের পীড়া ও হাঁপানিসহ কতিপয় রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে।  
উপরের ঘটনা দু’টি বিশ্লেষণ করলে- দেখা যায় যে ব্যক্তির পীড়নমূলক অবস্থা তার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, পীড়নের প্রভাবে ক্যানসারের সদৃশ শারীরিক ব্যাধিও প্রভাবিত হয়। 
হ্যানস সেলী (১৯৩৬) নামে একজন চিকিৎসকের মতে, ব্যক্তি যখন দীর্ঘস্থায়ী  এবং কষ্টদায়ক পীড়নমূলক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তখন প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয় স্নায়ু ব্যবস্থা সক্রিয় হয়, ২য় পর্যায় প্রতিরোধ পর্যায়। এ পর্যায়ে ব্যক্তি সকল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে এবং ব্যক্তি পীড়নের সাথে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করে। যদি তখনো পীড়ন অব্যাহত থাকে তবে তখন ব্যক্তি পীড়নের প্রতি প্রতিক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়।  ব্যক্তির নানা প্রকার শারীরিক সমস্যা যেমন- পাকস্থলির সমস্যা, রক্তচাপ বৃদ্ধি ইত্যাদির দ্বারা সে নিজেকে ঐরূপ পরিবেশ সাথে তথা পীড়নের সাথে অভিযোজন ঘটায়। ৩য় পর্যায়ে যদি পীড়ন তখনো বহাল থাকে, তখন শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং ব্যক্তির শারীরিক কোষ কলার ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ব্যক্তি শারীরির অবসন্ন হয়ে পড়ে এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
পীড়ন মোকাবেলার ক্ষমতা সকল ব্যক্তির সমান নয়। পীড়ন সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। পীড়ন দীর্ঘস্থায়ী হলে ব্যক্তির অভূতপূর্ব শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধিত হয়। 
পীড়নের সাথে অসুস্থতার সম্পর্ক: (১) পীড়ন সব সময় সরাসরি স্বাস্থ্য ব্যাধি সৃষ্টি না করলেও  পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক আচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাধির কারণ হতে পারে। যেমন-তীব্র পীড়নের ফলে সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপানের পৌনঃপূণ্যতা বেড়ে যেতে পারে, নিদ্রার ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে, মদ্যপানের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ফলে পীড়নের পরবর্তী এরূপ অব্যবস্থাপনা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আচরণ পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে ব্যক্তির স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াতে সক্ষম। 
(২) দৈহিক দুর্বলতা তত্ত্ব: এই ততত্ত্ব অনুসারে পীড়নের সম্মুখীন হলে ব্যক্তির যে শারীরিক প্রণালীটি সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল, সেই প্রণালীটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন যার ফুসফুস জম্মগত ভাবে দুর্বল, পীড়ন হলে হয়তো তার হাঁপানি বেড়ে যেতে পারে। 
(৩) জ্ঞানীয় ও আচরণমূলক তত্ত্ব: ব্যক্তির নেতিবাচক আবেগ যেমন-অনুশোচনা, শোক, উদ্বেগ, ভবিষ্যৎ চিন্তা -এগুলো স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুমন্ডলকে অনবরত উত্তেজিত রাখে। উত্তেজিত অবস্থা তীব্র হলে ব্যক্তির শারীরিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় ফলে নানাবিধ শারীরিক সমস্যা তখন দেখা দেয়।
পীড়ন ব্যবস্থাপনা: (১) উত্তেজনা হ্রাসকরণ: ব্যক্তিকে পেশির শ্লথন হ্রাসের শিক্ষা দেওয়া হয়। নিয়মিত শ্লথন অভ্যাস করলে ব্যক্তির পীড়ন মোকাবেলা ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
(২) আচরণমূলক কৌশল বা দক্ষতা শিক্ষণ: ব্যক্তিকে কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সময় ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে ব্যক্তির পীড়ন মোকাবেলা ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। 
(৩) পরিবেশ ও সামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন: ব্যক্তির সামাজিক সমর্থন বৃদ্ধি করার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং সাথে সাথে পরিবেশ পরিবর্তন ও স্বাস্থ্য সম্মত আচরণের জন্য উপযুক্ত ভাবে পরিবেশ পুনর্গঠন করা হয়। 
পীড়ন ক্রমে ক্রমে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকিকে বাড়ায়ে তুলতে সক্ষম। তাই পীড়নকে মোকাবেলা ক্ষমতা বৃদ্ধি পীড়নের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার অন্যতম সহায়ক পথ হিসেবে বিবেচিত। প্রয়োজনে একজন দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ গ্রহণ করে পীড়নকে মোকাবেলা করা সম্ভব। 
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা। ফ্রি পরামর্শ: ০১৭১৪৬১৬০০১