খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৬ জুন ২০২৫ | ১২ আষাঢ় ১৪৩২

মানসিক চাপ কি আপনাকে তিলে তিলে শেষ করে ফেলছে? জেনে নিন তার কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী, মনোবিজ্ঞানী |
০১:১১ এ.এম | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

কেস স্ট্যাডি-১ঃ লিটন সাহেব (ছদ্ম নাম) অফিসের একজন বস। স¤প্রতি তার পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তথা স্ত্রী’র সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চির ধরতে শুরু করেছে। বিষয়টি তার নিকট বেশ মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে তার মধ্যে উদ্বিগ্নতা ও হতাশা ভর করেছে। তিনি কোন কাজে মন বসাতে পারেন না, অল্পতেই সহকর্মীদের উপর রেগে যান। প্রায় সময় তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দিন অতিবাহিত করে থাকেন।
কেস স্ট্যাডি-২ঃ রিপন (ছদ্ম নাম) বয়স ৩১ বছর। চাকুরির বয়স চলে যাওয়ায় প্রত্যাশিত চাকুরি না পাওয়ায় তার মনের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ও দুঃখ বিদ্যমান। মন তার প্রায় খারাপ থাকে। বেশ কিছু দিন হলো তার মধ্যে আবেগীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইদানিং তার মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা যেমন- রক্ত চাপ বৃদ্ধি পাওয়া, বুক ধর ফর করা, খাওয়ায় অরুচি, নিদ্রাহীনতা ইত্যাদি দেখা দিয়েছে।
জীবনে চলার পথে কখনো কখনো কোন ঘটনা আমাদের মনের উপর গভীর ভাবে নেতিবাচক রেখাপাত তৈরি করে। উপরের দু’টি ঘটনা ব্যক্তিদ্বয়ের মনের উপর গভীর নেতিবাচক প্রবণতা সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, যা এক প্রকার মানসিক চাপ হতে উৎপত্তি হতে পারে। জীবনকে অর্থবহ রুপে গড়ে তুলতে সহনীয় পর্যায়ের মানসিক চাপ থাকা প্রয়োজন আছে। কিন্তু চাপ যখন অর্থবহতার উর্ধ্বে স্থান পায়, তখন তাহা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য সমস্যায় রুপ নিয়ে থাকে। মানসিক চাপ শব্দটি ফাইট অর ফ্লাইট (যুদ্ধ কর অথবা পালাও) সমরুপি ভাবধারার সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ।
ক্রনিক পর্যায়ের চাপের ফলে যে সব শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় : ব্যক্তির (১) ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়, (২) হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা দেখা দেয়, (৩) ব্যক্তির মাথা ঘোরাতে পারে, (৪) হৃদ স্পন্দন বেড়ে যেতে পারে, (৫) ঘন ঘন প্রগ্রাব হতে পারে, (৬) ব্যক্তির ডাইরিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে এমন কি আইবিএস পর্যন্ত দেখা দিতে পারে, (৭) নাড়ি ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যেতে পারে, (৮) শ্বাস কষ্ট দেখা দিতে পারে।
সামাজিক লক্ষণ : (১) ব্যক্তির মধ্যে হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা ও অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়, (২) ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, (৩) ব্যক্তি পরিবার-পরিজন অথবা বন্ধু-বান্ধব থেকে খানিকটা আলাদা হয়ে যায়, (৪) জীবন যাপন প্রণালীতে স্বাভাবিকতার ছন্দপতন ঘটে, (৫) ব্যক্তি বেশির ভাগ লোকের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে ব্যর্থ হয়, (৪) কোন কথা বললেই সহজে রেগে যায়, (৫) ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
মানসিক চাপের শারীরিক কারণ : মানসিক চাপ আমরা সবাই কম বেশি অনুভব করি। মূলতঃ- দু’টি পদ্ধতিতে ব্যক্তি মানসিক চাপ অনুভব করেঃ (১) হরমোন জনীত কারণে, (২) প্রতিরক্ষা পদ্ধতির কারণে। আমাদের শরীরে হরমোন গুলোর কার্যকারিতা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। হরমোন গুলোর সুষম নিঃস্বরণে আমাদের আচরণে স্বাভাবিকতা বজায়ে থাকে। শরীর জুড়ে হরমোনের প্রভাব বিভিন্ন অক্ষ বা axis এ কল্পনা করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে HPA axis  এবং HPG axis  মানসিক চাপ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
HPA বা Hypothalamus, Pituitary and Adrenal gland  চাপ প্রতিক্রিয়ায় এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউরো এনডোক্রাইন অভিযোজন উপাদান গুলিকে এক সূত্রে আবদ্ধ করতে এ ধীরং এর ভূমিকা অপরিসীম। এ প্রক্রিয়ার স¦াভাবিক কাজ কর্মে ব্যাঘাত ঘটলে চিন্তা, অনুভূতি ও কল্পনা, স্মৃতিতে সমস্যা দেখা দেয় ফলে ব্যক্তির মধ্যে মানসিক চাপমূলক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
HPG বা Hypothalamic-pituitary-gonadal axis এটা হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি এবং গোনাড এর মধ্যকার সম্পর্কে নির্দেশ করে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী ম্যাকানিজম যা আমাদের যৌনক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ এবং বিকাশ প্রক্রিয়া ও শারীরিক প্রতিরক্ষা সিস্টেমের সাথে জড়িত। সা¤প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই সিস্টেম থেকে নির্গত হরমোন আমাদের স্মৃতিশক্তি রক্ষা, উৎকন্ঠা ও ভয় থেকে রক্ষার কবচ হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে। অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি থেকে আমরা যা শিখে থাকি, তাহা পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ মোকাবেলায় ভূমিকা রাখে। সঙ্গত কারণে এই অক্ষ সমূহ যখন সঠিক ভাবে কাজ করতে পারে না, তখন আমাদের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
চাপের জীবন ভিত্তিক কারণ : চাকুরি সংক্রান্ত বা চাকুরি হতে অবসর, অর্থনৈতিক সমস্যা, পরিবারগত সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা, সম্পর্ক, বিবাহ বা বিচ্ছেদ সংক্রান্ত, দুর্ঘটনা, গন্ডগোল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশগত সমস্যা সহ জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক অসংখ্য বিষয় হতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে।
চাপ মোকাবেলায় করণীয় : (১) খাদ্য সংক্রান্ত : মানসিক চাপ আমাদের শরীরের কোষ সমূহের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। সে জন্য এ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার ফল-মুল ও শাক-সবজি, বাদাম, সীয়া সীড বা বিভিন্ন সীড জাতীয় খাবার, ডার্ক চকোলেট খাওয়া যেতে পারে। তার সাথে বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার যেমন- কলা, মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া যেতে পারে। এতে চাপ কমে যেতে পারে। (২) শারীরিক ব্যায়াম : প্রতি দিন নিয়ম করে কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। ব্যায়ামের ফলে শরীরের কোষে কোষে অক্সিজেন বৃদ্ধি পায়, তাহা ছাড়া ব্যায়ামের ফলে ডোপামিন ও সেরোটনিন নামক নিউরোট্রানেন্স মিটারের ক্ষরণ বেড়ে যায়, যা মেজাজকে ভালো রাখতে সহায়তা করে এবং চাপ কমাতে সাহায্য করে। (৩) নেশাজাতীয় দ্রব্য বর্জন : এলকোহল বা ধূমপান বা ক্যাফেইন চাপ কমানোর পরিবর্তে চাপকে আরো বাড়িয়ে দেয়, সে জন্য নেশাজাতীয় দ্রব্য একেবারেই বর্জন করতে হবে। বাজারের প্রচলিত ক্যাফেইন সমৃদ্ধ চায়ের পরিবর্তে গ্রিন টি বা ক্যামোমাইল টি খাওয়া যেতে পারে, (৪) যেহেতু মানসিক চাপের সঠিক উদ্দীপক সব সময় শনাক্ত করা কঠিন তাই সে জন্য চাপ মোকাবেলায় কতকগুলো সাধারণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে, যেমনঃ (ক) পর্যাপ্ত ঘুম : ব্যক্তির পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করা হলে চাপ অনেকটা কম থাকবে। (খ) শ্লথন প্রশিক্ষণ : চাপগ্রস্ত ব্যক্তিকে ব্যাপক শ্লথন প্রশিক্ষণ প্রদান করা যেতে পারে। (গ) চাপমূলক পরিস্থিতিতে যথা সম্ভব উত্তেজিত না হওয়া বা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করার পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে। (ঘ) হাসি প্রশিক্ষণ- ব্যক্তি মন খুলে হাসতে পারলে হাসির সাথে সাথে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ফুসফুস, হার্টে প্রবেশ করে। এতে ব্যক্তির লান্স ও হার্ট ভালো থাকে। (৫) ব্যক্তির সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করা : যাতে ব্যক্তির সক্ষমতা বোধ অক্ষুণœ থাকে- এসব কৌশলের মধ্যে আছে- (ক) জ্ঞানীয় সংগঠনের প্রভাব- বিভিন্ন পরিস্থিতিকে মানসিক চাপগ্রস্ত ব্যক্তি ভুল ভাবে মূল্যায়ন করে এবং ঋণাত্মক ঘটনা ঘটার সম্ভবনা বাড়িয়ে দেখে। সে জন্য চাপগ্রস্ত ব্যক্তিকে এসব পরিস্থিতিকে পুনর্মূল্যায়ন করতে সাহায্য করা উচিৎ। (খ) মানসিক চাপগ্রস্ত ব্যক্তিকে সমস্যা সমাধানমূলক আচরণের শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।
(লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।)