খুলনা | শুক্রবার | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১২ পৌষ ১৪৩১

জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস : ইতিহাস ও বাস্তবতায় জিয়াউর রহমান

|
১২:০৪ এ.এম | ০৭ নভেম্বর ২০২৪


১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম কয়েকটি দিন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বিশেষ করে ৭ নভেম্বর। এ দিনেই সিপাহী জনতার দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা হয়, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এ দেশের ইতিহাসে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। সিপাহী ও সর্বস্তরের জনতার সচেতনতা ও দেশপ্রেম সেদিন দেশকে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করে। ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। 
১৯৭৫ সালের এই দিনে আধিপত্যবাদী চক্রের সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল। তাদের ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমেই রক্ষা পায় সদ্য অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কয়েকদিনের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে সিপাহী-জনতা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশা থেকে মহান স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে মুক্ত করে দেশ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তুলে দেয় তার হাতে। তাই ৭ নভেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যমন্ডিত দিন। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদ, একনায়কতস্ত্র, একদলীয় শাসন, জনজীবনের বিশৃঙ্খলাসহ তৎকালীন বিরাজমান নৈরাজ্যের অবসান ঘটে। অস্থিতিশীলতা উজিয়ে দেশে সুশৃঙ্খল পরিবেশ ফিরে আসে।
১৯৭৫ সালের ৩ থেকে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী দল সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় দেশের সাধারণ জনগণ ও সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সর্বমহলে, বিশেষত সিপাহীদের কাছে ছিলেন খুবই প্রিয়। ফলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ ও জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ এক বিপ্লব, যা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে মর্যাদার আসন লাভ করেছে।  
দেশবাসী সেদিন জিয়াউর রহমানের হাতেই তুলে দিয়েছিল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা স্বকীয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চক্রান্তকারীদের খপ্পর থেকে দেশকে উদ্ধার করে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তিকে নিকুচি করে সত্যিকার স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে স্থান করে নেয়। ওই সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ (গুটিকয় বৈদেশিক অনুচর ছাড়া) এবং সশস্ত্রবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা নিয়ে দেশকে উন্নতি, অগ্রগতি ও শান্তির পথে নিয়ে যায়। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী, দেশীবিরোধী সকল ষড়যন্ত্র। আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।
৭ নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে তদানীন্তন দৈনিক বাংলার রিপোর্টে বলা হয়, সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চারদিনের দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ১টায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহী-জওয়ানরা বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করেছেন বিপ্লবী সিপাহীরা। সেই ৭ নভেম্বর ছিল শুক্রবার। সেদিন ভোরে রেডিওতে ভেসে আসে, ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলছি।’ জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহŸান জানান। ওইদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ নেমে আসেন রাজপথে। সাধারণ মানুষ ট্যাঙ্কের নলে পরিয়ে দেন ফুলের মালা। বারুদের গন্ধ ছাপিয়ে ভেসে আসে ফুলের সুবাস। এই আনন্দের ঢেউ রাজধানী ছাড়িয়ে দেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাঁক বদলের তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানেই দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। ১৯৭৫ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেও দলটির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সাঈদ ইফতেখার বলছেন, দু’টো গণঅভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক শূন্যতার সুবিধা পেয়েছে বিএনপি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আ’লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, জন-বিদ্রোহ বা জনরোষের ফলে যে সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেটার রাজনৈতিক ফসল বিএনপি ঘরে তুলেছে।  
তবে বিগত ১৭ বছর ঐতিহাকি ৭ নভেম্বরকে বিতর্ক সৃষ্টি করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ইতিহাস বিকৃতি করেছিল। ইতিহাসের অমোঘ সত্য সেটি আবারও জাগ্রত হয়ে ফিরে এসেছে সিপাহী-জনতার পাশে। হাসিনা সরকার ইতিহাস থেকে ৭ নভেম্বরকে চিরতরে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করেছিল। কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সে কারণেই চলতি বছরের ৫ আগস্ট নতুন বিপ্লবের মাধ্যমে ৭ নভেম্বর জনতার মাঝে ফিরে এসেছে স্বমহিমায়।
মার্কিন বিপ্লবী ফ্রেডেরিক অ্যালেন হাম্পটন সিনিয়র বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পথিকৃত হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। তিনি বলতেন, তুমি একজন বিপ্লবীকে মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু বিপ্লবকে মেরে ফেলতে পারবে না। সত্যিই তাই। বিপ্লব চিরঞ্জীব। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ইতিহাসও তাই অমোচনীয়, অনস্বীকার্য।