খুলনা | বুধবার | ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বন্ধ স্কুল-ইন্টারনেট সেবা

ভারতে মসজিদে সমীক্ষা ঘিরে সংঘাত, নিহত ৪

খবর প্রতিবেদন |
০১:০৯ এ.এম | ২৬ নভেম্বর ২০২৪


ভারতের উত্তর প্রদেশে বিধানসভা উপ-নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর অশান্তির আগুন ছড়ালো। সামভালে মুঘল আমলের একটি মসজিদকে ঘিরে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। প্রাচীন এই মসজিদে ‘সার্ভে’ বা সমীক্ষা করানোর নির্দেশকে ঘিরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় তীব্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যাতে অন্তত চারজন মুসলিম নিহত হয়েছেন। 
সামভালে হিন্দু ও মুসলিম স¤প্রদায়ের মাঝে বিক্ষোভ-সহিংসতায় চারজনের প্রাণহানির পর ওই এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ বাতিল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। ষোড়শ শতকের ঐহিত্যবাহী শাহী জামা মসজিদে আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা চলাকালীন রোববার বিক্ষোভকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। ভারতীয় বার্তাসংস্থা পিটিআইয়ের বরাত দিয়ে সোমবার  এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু। 
সংবাদমাধ্যম বলছে, উত্তর প্রদেশের সামভালে মুঘল আমলের একটি প্রাচীন মসজিদে ‘সার্ভে’ বা সমীক্ষা করানোর নির্দেশকে ঘিরে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের মধ্যে রোববার দফায় দফায় তীব্র সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। সহিংসতায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫০ জন পুলিশ সদস্য।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা সংঘর্ষের ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, মসজিদের চারপাশে জুতো, ইট ও পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিক্ষোভকারী মুসলিমরা অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশের গুলিতে অন্তত চারজন মারা গেছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভারতের ইংরেজি দেওয়া সাক্ষাৎকারে সামভালের পুলিশ সুপার কৃষাণ কুমার বলেন, ‘‘সেখানে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিতে পারে, এমন কোনও অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।’’
উত্তর প্রদেশ রাজ্য কর্তৃপক্ষ সহিংসতার এই ঘটনায় চারটি মামলা দায়ের করেছে। এর আগে, গত সপ্তাহে স্থানীয় একটি আদালত মসজিদটির স্থানে সমীক্ষা চালানোর আদেশ দেন। মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি মন্দিরের স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে বলে দাবি করে হিন্দুরা একটি পিটিশন দায়েরের কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে সমীক্ষার আদেশ দেন আদালত। 
শহরের যে মসজিদটিকে ঘিরে এই বিরোধ দেখা দিয়েছে সেটি ‘শাহী জামা মসজিদ’ নামে পরিচিত। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির দাবি, প্রাচীন একটি হিন্দু মন্দির ভেঙেই এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল, ওই ভবনের স্থাপত্যে নাকি এখনও তার প্রমাণ রয়েছে। রোববারের এই সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীরা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের পাশাপাশি ও লাঠিচার্জ করে পুলিশ।
মোরাদাবাদের বিভাগীয় কমিশনার অঞ্জনেয়া কুমার সিং জানিয়েছেন, “দুর্বৃত্তরা গুলি চালিয়েছিল পুলিশ সুপারের পিআরও’র পায়ে গুলি লেগেছে, পুলিশ সার্কেল অফিসার পেলেটের আঘাতে আহত হয়েছেন এবং সহিংসতায় ১৫ থেকে ২০ জন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছেন।” তিনি আরও দাবি করেন, একজন কনস্টেবলের মাথায়ও গুরুতর আঘাত লেগেছে এবং ডেপুটি কালেক্টরের পা ভেঙে গেছে। দ্য হিন্দু বলছে, সংঘর্ষের এই ঘটনার পর সামভাল তহসিলে ইন্টারনেট পরিষেবা ২৪ ঘণ্টার জন্য স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে এবং জেলা প্রশাসন ২৫ নভেম্বর (সোমবার) দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত ছাত্রদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করেছে।
এদিকে হিন্দু মন্দির ভেঙে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসিলম গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আদালতে আইনি লড়াইও চলছে দীর্ঘদিন ধরে। স¤প্রতি আদালত ওই মসজিদ প্রাঙ্গণে সার্ভে করানোর নির্দেশ দেওয়ার পর থেকেই নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। ওই মসজিদ ভবনটিতে আগে কোনও হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল কি না, সেটা যাচাই করে দেখার জন্যই ওই সার্ভের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। 
সামভালের পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, রোববার সকালে প্রশাসনের একজন ‘এ্যাডভোকেট কমিশনার’র নেতৃত্বে একটি সার্ভে টিম মসজিদে তাদের কাজ শুরু করতেই বাইরে বিরাট জনতা জড়ো হয়ে যায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সহিংসতা শুরু হয়ে যায়।
এর আগে রোববার সকাল সাড়ে সাতটায় মসজিদ চত্বরে সার্ভের কাজ শুরু হয়। মোরাদাবাদের ডিভিশনাল কমিশনার অঞ্জনেয় কুমার সিংকে উদ্ধৃত করে বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, নিহত তিনজনের নাম নাঈম, বিলাল ও নোমান। 
উলে­খ্য, মুঘল আমলে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির ভেঙে এই জামা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল এবং এখন তা হিন্দুদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে এই দাবি নিয়ে একদল আবেদনকারী আদালতের শরণাপন্ন হলে এই সার্ভের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই আবেদনকারীদের যুক্তি ছিল, ‘বাবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’র মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে ১৫২৯ সালে মুঘল বাদশাহ বাবর সামভালে হিন্দু মন্দির ভেঙে ওই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এই ‘ঐতিহাসিক সত্য’টি উদ্ঘাটন করার জন্যই শাহী জামা মসজিদে সার্ভে চালানো প্রয়োজন বলে তারা দাবি করে আসছিলেন।
অন্যদিকে মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সার্ভের বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, ভারতের ধর্মীয় উপাসনালয় আইন ১৯৯১ অনুসারে দেশের স্বাধীনতার সময় কোনও মন্দির, মসজিদ বা গীর্জার চরিত্র যা ছিল তা বদলানো যায় না- সুতরাং সামভালের জামা মসজিদেও এই ধরনের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। এছাড়া মসজিদে এভাবে ‘সার্ভে’ চালানো হলে তা এলাকায় অযথা উত্তেজনা ছড়াবে বলেও তারা সতর্ক করে আসছিলেন।
এদিকে, জামা মসজিদের ভবনে একসময় হিন্দু মন্দির ছিল এই দাবি আগেও জানিয়ে এসেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। শিবরাত্রির সময় ওই প্রাঙ্গণে নির্মিত কূপের পূজা দেওয়ার চেষ্টা হয় বলেও মুসলিম সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে এই প্রথম আদালতে এই মসজিদকে নিয়ে কোনও মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মুসলিম পক্ষের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলেছেন, ‘‘মামলা দায়ের করে এই মসজিদকে বিতর্কিত বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে এই নিয়ে কোনও মামলা হয়নি।’’
মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে জাফর আলীও একই কথা বলেছেন। তার মতে, ‘‘এই মসজিদ নিয়ে কিন্তু কোনও আইনি বিবাদ নেই। যদিও হিন্দু সংগঠনগুলো মাঝে মাঝেই এই মসজিদ নিয়ে বিবাদ সৃষ্টি করে।’’
আইনজীবী মাসুদ আহমেদ বলছেন, ‘‘বিস্ময়কর বিষয় হলো, মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে এই মামলা দায়ের করা হলো, বিরোধীদের বক্তব্য না শুনেই জরিপের নির্দেশ দেওয়া হলো এবং একই দিন সন্ধ্যায় জরিপও করা হলো। অথচ ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার। এতেই বোঝা যাচ্ছে গোটা পরিকল্পনার আড়ালে একটা বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। তবে আমরা আইনি লড়াই লড়তে প্রস্তুত। অপর পক্ষের দাবি আদালতে টিকবে না।’’