খুলনা | শুক্রবার | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

বাতিল হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দায়মুক্তি আইন

খবর প্রতিবেদন |
১২:৪৯ এ.এম | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪


প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া কাজ দিতে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই আইনের অধীন কোনো সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না, এমন বিধান থাকার কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত পায়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই দায়মুক্তি আইন বাতিল করেছে সরকার।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আইনটি বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে শনিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়, সংসদ কার্যকর না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে আইনটি বাতিল করার হয়েছে। ‘এ আইনের অধীন সম্পাদিত সব চুক্তি বা চুক্তির অধীন নেওয়া কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে। ওই সব চুক্তির চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে’।
এর আগে ১৪ নভেম্বর আইনের দু’টি বিধান অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৮ আগস্ট বিশেষ বিধান আইন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল। বলা হয়, এ আইনের অধীন ক্রয় প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে।
জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাময়িক সময়ের জন্য আইনটি করার কথা বলা হলেও দফায় দফায় এটির মেয়াদ বাড়িয়েছিল গত সরকার। সর্বশেষ বিশেষ বিধান আইনটির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। এ আইনের অধীন নেওয়া হয় শতাধিক প্রকল্প। কয়েক লাখ কোটি টাকার কেনাকাটা হয়েছে আইনটির আওতায়। দীর্ঘদিন ধরে এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। এই আইনের অধীনই আলোচিত রেন্টাল (ভাড়াভিত্তিক), কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল।
অসহনীয় লোডশেডিং পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুরুতে বিশেষ বিধান আইনকে সমর্থন দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও দায়মুক্তি নিয়ে আপত্তি ছিল সব সময়। আইন জারির পর তিন বছর মেয়াদি ১৭টি দ্রুত ভাড়াভিত্তিক (কুইক রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর পাঁচ বছর মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন করতে থাকে আওয়ামী লীগ সরকার। জ্বালানি তেলচালিত এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। তাই সাময়িক সময়ের জন্য চুক্তি করা হলেও পরে ব্যবসায়ীদের বাড়তি সুবিধা দিতে এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়। একপর্যায়ে সমালোচনার মুখে ‘বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই’ শর্তে তাদের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বর্তমানে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আর সচল নেই। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ১৫ থেকে ২৫ বছর মেয়াদে আরও বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করা হয়। এতে পিডিবির উৎপাদন খরচ বাড়তেই থাকে।
পিডিবির সর্বশেষ নভেম্বরের তথ্য বলছে, দেশে এখন মোট বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৪৩টি। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ৬২ আর বাকি ৮১টি বেসরকারি খাতের। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট।
বিশেষ বিধান আইনে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে জ্বালানির নিশ্চয়তা ছাড়াই। ফলে সক্ষমতা থাকলেও চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় তিন বছর ধরে গ্রীষ্ম মৌসুমে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। অথচ এ বাড়তি সক্ষমতার দায় গুণছে পিডিবি।
চুক্তি অনুসারে প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্রভাড়া দিতে হয় পিডিবির। বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও এটি দিতে হয়, না করলেও এটি দিতে হয়। তবে অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্রভাড়া দিলে পিডিবির লোকসান বেড়ে যায়। গত দেড় দশকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়ার পেছনে। ২০২২-২৩ অর্থবছরেও বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া পরিশোধে পিডিবির খরচ হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পিডিবির এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১১ টাকা। অথচ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৭ টাকা ২ পয়সায়। এতে আয়-ব্যয়ে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে পিডিবির। গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে নিয়মিত হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। সরকারের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
শুধু বিদ্যুৎ নয়, গ্যাস আমদানিতেও ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ বিধান আইন। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে বেসরকারি খাতে দু’টি ভাসমান টার্মিনাল করা হয়েছে এই আইনে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে এই আইনের অধীন।