খুলনা | শুক্রবার | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি: রিউমার স্ক্যানা

খবর প্রতিবেদন |
০৭:৫৭ এ.এম | ০১ ডিসেম্বর ২০২৪


ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতার পর, শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। এসব গুজবের মধ্যে রয়েছে সারাদেশে সংঘর্ষ, হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা—এমন খবরও। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পর এইসব গুজব ভারতের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে, ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর পাওয়া গেছে। এসব খবরের মধ্যে ৪৯টি ভারতীয় গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে রিপাবলিক বাংলা সবচেয়ে বেশি ৫টি গুজব প্রচার করেছে। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ, এবং লাইভ মিন্ট, যারা প্রত্যেকে অন্তত ৩টি করে গুজব প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, রিপাবলিক, ইন্ডিয়া টুডে, এবিপি আনন্দ, এবং আজতক অন্তত ২টি করে গুজব ছড়িয়েছে। বাকিরা অন্তত একটি গুজব প্রকাশ করেছে।

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভুয়া খবরের মধ্যে রয়েছে— শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তার নামে ভুয়া খোলা চিঠি: এমন দাবি ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছিল শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। তবে, রিউমর স্ক্যানারের তদন্তে জানা যায়, শেখ হাসিনা এমন কোনো চিঠি দেননি। এই চিঠি প্রথমে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে ভারতের আগরতলা ভিত্তিক পত্রিকা ‘ত্রিপুরা ভবিষ্যত’-এ প্রকাশিত হয়। এরপর এটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভারতের বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।

মুসলিম ব্যক্তির নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন: ভারতীয় গণমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচারিত হয়, যেখানে দাবি করা হয়, একজন হিন্দু ব্যক্তি তার নিখোঁজ ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন করছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই ব্যক্তি আসলে মুসলিম এবং তার নাম বাবুল হাওলাদার, যিনি ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া ছেলের সন্ধানে মানববন্ধন করেছিলেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিইউতে ভর্তি: ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছেন। তবে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ছবিটি ড. ইউনূসের নয় এবং তিনি সুস্থ আছেন।

বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া: ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশে কিছু নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার এই দাবির কোনো সত্যতা পায়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূসের ফ্রান্সে পালিয়ে যাওয়ার গুজব: ভারতের কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, ট্রাম্পের বিজয়ের পর ড. ইউনূস ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, পালানোর যে প্রমাণ হিসেবে একটি বিমানের ছবি প্রচারিত হয়, সেটি আসলে ৮ আগস্টের ছবি, যখন ড. ইউনূস ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে ফিরছিলেন।

পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনার মিথ্যা দাবি: ১৩ নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার নিয়ে একটি জাহাজ আসে। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, এই জাহাজটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক জাহাজ ছিল এবং এটি অস্ত্র নিয়ে আসছে। তবে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি একটি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং এর মাধ্যমে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আনা হয়েছে।

চিন্ময় কৃষ্ণের আইনজীবীকে হত্যার গুজব: চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণের মামলায় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম নিহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, তাকে হত্যা করা হয়েছে কারণ তিনি চিন্ময়ের আইনজীবী ছিলেন। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার জানায়, সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের আইনজীবী ছিলেন না, তার আইনজীবী ছিলেন শুভাশীষ শর্মা।

ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার গুজব: ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম দাবি করে যে, বাংলাদেশে ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব চ্যানেল এখনও সচল রয়েছে।

বিমানবাহিনীর নতুন বিমানঘাঁটি নির্মাণের গুজব: কিছু গণমাধ্যমে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী চীনের সাহায্যে লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, এবং লালমনিরহাটের বিমানবন্দর দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

হিন্দু মন্দিরে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুরের ভিডিও: একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে মুসলিমরা হিন্দু মন্দিরে হামলা করে প্রতিমা ভাঙচুর করেছে। তবে, রিউমর স্ক্যানারের তদন্তে জানা যায়, এটি আসলে ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ সুলতানপুর গ্রামে প্রতিমা বিসর্জনের দৃশ্য।

শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলা ও ভারতবিরোধী স্লোগান: ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে শ্যামলী পরিবহনের বাসে হামলা করা হয়েছে এবং ভারতীয় যাত্রীদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দাবির কোনো সত্যতা নেই এবং দুর্ঘটনাটি মূলত ওভারটেকিংয়ের কারণে ঘটেছিল।

এই গুজবগুলো প্রমাণ করে, কিছু ভারতীয় গণমাধ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য ছড়িয়ে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করার চেষ্টা করছে।