খুলনা | শনিবার | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৪ পৌষ ১৪৩১

উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত

দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কসহ একুশ রুটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার যান

আল মাহমুদ প্রিন্স |
০১:১৬ এ.এম | ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪


উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এখনো খুলনা-মোংলা মহাসড়কসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কসহ ২১ রুটে বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু, ইজিবাইক ও মাহেন্দ্রসহ অবৈধ তিন চাকার যান। হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে চালানো হচ্ছে এসব যান। এর নেই ইমারজেন্সি ব্রেক। এসব যানের ধাক্কায় ঘটছে প্রাণহানী ও পঙ্গুত্ব। ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, ক্ষতি হচ্ছে জানমালের। এসব যান অচিরেই বন্ধের জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)’র খুলনা জেলা ও মহানগর শাখার শীর্ষপদের নেতারা। অবৈধ যান চলাচলের কারণে বৈধ পরিবহন ব্যবসায়ীরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে একের পর এক। বৈধ যান চালকদের সাথে খারাপ আচরণসহ নির্যাতন চালানো হয় বাস-মিনিবাস শ্রমিকদের উপর। 
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রূপসার নৈহাটী ইউনিয়নের বাগমারা গ্রামের বাসিন্দা ভাষান মোল­ার ছেলে সাইফুল ইসলাম গত বছর ২১ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোটরসাইকেল যোগে কাজদিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি নৈহাটী বালিকা বিদ্যালয়ের অদূরে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা নিষিদ্ধ ঘোষিত অবৈধ যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মোটরসাইকেল চালককে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলে মারা যান। এর আগে ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি সকালে রূপসার শিয়ালি এলাকায় ট্রলির ধাক্কায় নছিমনের চালকসহ চারজন গুরুতর আহত হয়। আহতরা হলেন তপন  বৈরাগী (৫০), বিদুর হালদার (৪৫), শিপন বিশ্বাস (৩৫) ও ভগীরথ বিশ্বাস (৪২)। একই বছর ২২ মার্চ রূপসার ঘাটভোগ ইউনিয়নের আনন্দনগর গ্রামে বেপরোয়া ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে ওই গ্রামের আকবর আলী সরদারের মেয়ে ও আনন্দ নগর ইবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্রী আখি মনি (৭) নামে এক স্কুলছাত্রী নিহত হয়। একই বছর ট্রলির ধাক্কায় রূপসার শ্রীরামপুর গ্রামের মোঃ শওকত শেখের ছেলে মোঃ রবিউল ইসলাম, একই এলাকার বাসিন্দা মোঃ ইদ্রিস আলীর ছেলে মোঃ রমজান আলী, নৈহাটী গ্রামের মোঃ শাহজাহান শেখের ছেলের মোঃ রাসেল, নেহালপুর গ্রামের মোঃ সাহেব আলীর ছেলে মোঃ মাইনুল ট্রলির ধাক্কায় গুরুতর আহত হওয়ার পর তাকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও তার একটি পা কেটে ফেলা হয়। একই গ্রামের মোঃ মিজানের পিতা ভ্যান চালক আঃ ওহাব (৬০) ইলাইপুর মোড়ে ট্রলির সাথে ধাক্কা লেগে গুরুতর আহত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুদিন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর তিনি মারা গেছেন। ২০২০ সালে ৮ জানুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে রূপসার নেহালপুর গ্রামের ইটভাটা শ্রমিক মোঃ লুৎফর রহমানের ছেলে শিশু মোঃ মহিদুল ইসলাম (১০) ইটবাহী ট্রলির ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়। ২০২০ সালের ৩ ফেব্র“য়ারি ১৪ বছরের ছেলে শেখ সাদী, ২৩ জুন বীরেন হালদার, ২০২১ সালের ২৮ আগস্ট মঞ্জিরা বেগম আহত হয়। ২০২২ সালের ২ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার শিক্ষা অফিস থেকে মোটরসাইকেলযোগে চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম (৪৫) খুলনা শহরে যাচ্ছিলেন। তিনি ঘাটভোগ ইউনিয়নের আলাইপুর ব্রিজ পার হয়ে আলাইপুর এলাকার তেমাথা নামক মোড়ে পৌঁছালে সড়কের পশ্চিম দিক থেকে আসা ট্রলির সাথে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ তিনি নিহত হন। ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী যুথি পাল, একই বছর ২ অক্টোবর চাঁদপুর কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ রফিকুল ইসলাম, একই বছর ১৬ নভেম্বর লুচি বেগম দুর্ঘটনার শিকার হন। ২০২৩ সালের ১ মার্চ পূর্ব রূপসা এলাকায় মোঃ রেজাউল ইসলাম নিহত হন। এছাড়া এর আগে এক এনজিও কর্মকর্তা রূপসার আলাইপুর ব্রিজ এলাকায় ট্রলির ধাক্কায় নিহত হন। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলার প্রধান সড়ক দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব অবৈধ তিন চাকার যান।  
বাস-মিনিবাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২১টি রুটে সাত (৭) মালিক সমিতির অধীনে আড়াই হাজার পরিবহন (বাস-মিনিবাস) চলাচলা করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে অবৈধ তিন চাকার যানবাহন চলাচলে দৌরাত্মের কারণে পরিবহন ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। যার কারণে বাগেরহাট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের সাথে সভা করলে ওইসব অবৈধ তিন চাকার যান চালকদের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া জন্য সংশ্লিষ্ট প্রসাশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তার পরও পূর্বের  মতো মাহেন্দ্র, অটোরিকশাসহ অবৈধ তিন চাকার যান চলাচলে এলাকার কতিপয় চাঁদাবাজদের ছত্র-ছায়ায় প্রশাসনের সহযোগিতায় চলাচল করছে। খুলনা- মোংলা মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে বিশেষ করে বাগেরহাটের কাটাখালি মোড় থেকে হাইওয়ে পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে অবৈধ তিন চাকার যান চলাচল করলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। এমনই লিখিত অভিযোগ করেছেন খুলনা আন্তঃজেলা বাস-মিনিবাস, কোস ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। একই সাথে চরম ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস, কোস ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। এসব ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন রূপসা-বাগেরহাট বাস-মিনিবাস, কোস ও মাইক্রোবাস মালিক সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মহিউদ্দীন শেখ, মোল­া সাইফুর রহমান, মোল­া আনোয়ারুল ইসলাম, মোঃ ইসমাইল হোসেন, এস এম মুর্শিদুর রহমান লিটন, আমিরুল ইসলাম তারেক, খুলনা আন্তঃজেলা বাস-মিনিবাস, কোস ও মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুম বিল­াহ ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ ইউনুচ গাজীসহ ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। 
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনা জেলা শাখার সভাপতি মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, সড়ক-মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান চলাচল অচিরেই বন্ধের প্রয়োজন। এসব যান চলাচলের কারণে মাঝে মাঝে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে। আবার কেউ পঙ্গুত্ববরণ করছে। ফলে নিরাপদ সড়ক চাই খুলনা জেলা শাখার পক্ষ থেকে সড়ক-মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান চলাচল করা হোক। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি। 
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) খুলনা মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান মুন্না বলেন, অবৈধ তিন চাকার যান সড়ক-মহাসড়কে কোনোভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। এসব যান চলাচলে অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে। পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সহযোগিতায় এসব অবৈধ তিন চাকার যান সড়ক-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব যান বন্ধ করা দরকার। তিনি বলেন, প্রধান কারণ হলো এসব যানগুলোর নেই কোনো ইমার্জেন্সি ব্রেক। অবৈধ তিন চাকার যান যাতে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এজন্য নিরাপদ সড়ক চাই খুলনা মহানগর শাখার পক্ষ থেকে জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।