খুলনা | রবিবার | ২০ জুলাই ২০২৫ | ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

তালায় চাল কুমড়ার বড়ি তৈরিতে ব্যস্ত গ্রামীণ মহিলারা

তালা প্রতিনিধি |
১১:২৮ পি.এম | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪


প্রতি বছরের মত এবারও তালার গ্রামীণ জনপদে নারীদের চাল কুমড়ার বড়ি তৈরিতে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। কুমড়ার বড়ি তৈরিতে শীতের সকালে হাজার হাজার বউ, শাশুড়ি, মা, বোনেরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
তালা, পাটকেলঘাটা সহ উপজেলার গোটা অঞ্চল জুড়ে মাসকলাই বা মুখ কলাই এর সাথে চাল কুমড়া দিয়ে শীত মৌসুমের প্রথম দিকে মাসকলাইয়ের ডালের আটা ও পাকা চাল কুমড়া মিশিয়ে এ সুস্বাদু বড়ি তৈরি করা হয়। এ অঞ্চলের নারীরা শত শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কয়েক মাস পূর্বে থেকে চাহিদা মত চাল কুমড়া পাকানোর ব্যবস্থা করে থাকেন। নতুন কলাই জমি থেকে ঘরে বা বাজারে আসার সাথে সাথে বড়ি তৈরির ধুম পড়ে যায় তাদের মাঝে। এ সব এলাকার ৮০ ভাগ মহিলারা পাল­া করে বড়ি দেয়ার কাজটি করে থাকেন। এক সময় রাস্তার দু’পাশে এই কলাইয়ের চাষ করতে দেখা যেতো কিন্তু এখন কৃষকের নানা ফসলের মধ্যে এঁটেল মাটিতে কলাইয়ের আবাদ করে থাকেন। দেশীয় কলাইয়ের পাশাপাশি এখন অনেক হাইব্রিড সহ নানা জাতের কলাই দেখা যায়। এদিকে বর্তমানে ভারতের কলাই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
বড়ির প্রধান উপাদান ভাল জাতের মাসকালই সংগ্রহ করে প্রথমে সূর্যের আলোতে শুকিয়ে যাতাতে ডালের আকার দেয়া হয় এবং ওই ডালকে পানিতে ৫/৬ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ভালভাবে হাত দিয়ে চটের ছালায় ঘষে ডালের খোসা ছাড়ানো হয়, তারপর পরিস্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হয়। শুকানো ডাল (যাতার দ্বারা) আটায় পরিণত করা হয় এবং শেষ রাতে বা খুব সকালে পাকা কুমড়াকে দু’ভাগ করে কেটে কুরানি দিয়ে চিকন করে নিয়ে কুমড়ার বিচি আলাদা করে নিতে হয়। 
ওই কলাইয়ের আটা ও কুরানো কুমড়া একটি পাতিলে মিশিয়ে দীর্ঘ সময় নাড়াচাড়া করতে হয়। মিশ্রণ ঠিকভাবে হয়েছে কি না তা দেখার মহিলারা মাঝে মাঝে বড়ির আকৃতি করে পানির পাত্রে ছেড়ে দিলে তা যদি ডুবে যায় তবে আরও ফেনাতে (নাড়াচাড়া করতে) হয়। আংশিক ভাসলে বড়ি তৈরি উপযোগি হয়েছে বলে তারা মনে করেন। তারপর মাটির তৈরি বড় ধরণের পাত্রে একত্রে মেশাতে হয়। এখন আধুনিক যুগে এগুলো প্রস্তুত করতে বিশেষ ধরণের মেশিন বাজারে দেখা যায়। ২/৩জন মহিলা সুতি পুরাতন কাপড়/মশারী কিংবা প্লাস্টিকের জ্বাল (নেট) বিছিয়ে দিয়ে এর উপর ওই মিশ্রণ বড়ি আকৃতি করে লাইন করে দেয়া হয়। ৫/৬ দিন ভাল করে রোদে শুকাতে হয়। মেঘলা ও ঘন কুয়াশা থাকলে বড়ি গন্ধ ও লাল হয়ে যায়। সেগুলি সহজে সিদ্ধ হয় না। খেতেও ভাল লাগে না। ভালোভাবে শুকিয়ে মুখ আটানো পাত্রে সংরক্ষণ করলে ১২ থেকে ১৪ মাস পর্যন্ত খাওয়া যায়। এক সময় বড়ি শীতের সকালে বাড়ির পাশে বা আঙিনায় কোন রৌদ্রের স্থানে দেওয়া হতো। এখন সময়ের পরিক্রমায় বাড়ির ছাদে বা মাচা বানিয়ে দেওয়া হয়। এটি তৈরিতে কোন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ বা ক্যামিকেল মেশানো লাগে না, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ভালো শুকাতেই তৈরি হয়ে যাবে একটি সুস্বাদু পুষ্টিকর খাবার।
দেখা গেছে, অনেক গৃহবধূরা মাসকলাই’র সাথে পিয়াজ, পাকা লাউ, আলু, পেঁপে, ওলকপি সহ নানা পদের সবজি মিশিয়ে বড়ি তৈরি করে থাকেন। বিশেষ করে পিয়াজের বড়ি বেশ সুস্বাদু কিন্তু এগুলো বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না। আগে যে কলাই বড়ি দেয়ার জন্য বিনামূল্যে পাওয়া যেতো সে কলাই এখন ৯০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বড়ি দেয়ার ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১২০ টাকা কেজি। কুমড়া বিক্রি হচ্ছে ২৫/৩০ টাকা কেজি এতে ১টি বড় সাইজের কুমড়া ১শ’ থেকে ১শ’ ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঘরে তৈরি করা ডালের বড়ি রেডিমেট কেনা ডাল দিয়ে বড়ির চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু। বড়ির উপকরণের মূল্য বেশি হওয়ায় বড়ি তৈরিতে এখন খরচ অনেক বেশি হচ্ছে। অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বড়ি তৈরি করে বিভিন্ন বাজারে হাটে বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এ এলাকার কুমড়া বড়ি এর চাহিদা রাজধানীর সহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
বর্তমানে বড়ির উপকরণের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধির কারণে তারা বড়ি তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বড়ির সাথে ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, বেগুন, হাঁস, মুরগীর ডিম বেশ মজাদার খাবার। বড়িকে এককভাবে রান্না করে খাওয়া যায়। বিদেশে বড়ি এখন বেশ জনপ্রিয়। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের নিকট বিদেশে বড়ি পাঠাচ্ছেন এবং বিদেশে পাড়ি দেয়ার সময় তরকারি হিসেবে বড়িকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ির ছাদে বড়ি তৈরি করা তালার  রতœা আক্তার জানান, বড়ির পুষ্টিগুণ অনেক বেশি, পেটের জন্য বেশ উপকারী, রুচিসম্মতভাবে খাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ক্ষুধা নিবারণের কাজ করে থাকেন।