খুলনা | বুধবার | ০৮ জানুয়ারী ২০২৫ | ২৫ পৌষ ১৪৩১

খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন : ফরহাদ মজহার

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৯ এ.এম | ০৫ জানুয়ারী ২০২৫


বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ আপসহীন লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট লেখক, দার্শনিক, গবেষক ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার। শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ফরহাদ মজহারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :-
বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেখা করেছেন। হয়তো তা নিছকই সৌজন্য সাক্ষাৎকার। কিন্তু তার ইতিবাচক তাৎপর্য রয়েছে। 
উপদেষ্টা সরকারের রাজনৈতিক এবং আইনি বৈধতার অভাব গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বৈরী ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। স¤প্রতি ছাত্র-তরুণরা জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র রাজধানীতে সভা করে পাঠ করতে চেয়েছে। সেটা তারা করতে পারেনি, কিংবা করতে দেওয়া হয়নি। উপদেষ্টা সরকারের মধ্যে তা নিয়ে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।  
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রস্তাবিত ঘোষণার সরাসরি বিরোধীতা করেন (দেখুন, ‘ছাত্রদের জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা পেছানোর নেপথ্যে’), এতে পরিষ্কার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে দু’টো পরস্পর বিরোধী ধারা গড়ে উঠেছে এবং তাদের পার্থক্য ও বিরোধ আগামীতে আরো তীব্র এবং ব্যাপ্ত হবে। যে প্রতিবিপ্লবী শক্তি আইন ও সংবিধানের দোহাই তুলে প্রতিবিপ্লব ঘটিয়েছে এবং আইন ও রাজনীতি উভয় দিক থেকে একটা সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার কায়েম করেছে আগামীতে এই গণবিরোধী প্রতিবিপ্লবী ধারাকে আরো পরিষ্কার চেনা যাবে। দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দায়িত্ব পালনের দিক থেকে সেনাবাহিনীকে আগামী দিনে হিমশিম খেতে হবে। বলাবাহুল্য জনগণ অবশ্যই সেনাবাহিনীকে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এই গৌরবজনক অবস্থানেই দেখতে চাইবে। সেনাবাহিনী এই গৌরব ধরে রাখবে-আমরা সাধারণ জনগণ সেটাই আশা করি।
৩ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে সেনাবাহিনী জনগণের পক্ষের শক্তি, প্রতিবিপ্লবী শক্তি নয়। রাজনীতির এই বাস্তব মেরুকরণ এবং আগামী দিনে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ বিচার করলে সেনাপ্রধানের এই সৌজন্য সাক্ষাৎকার জনগণ খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছে। আমি অতি সাধারণ মানুষ নিয়ে কারবার করি। সাধারণ মানুষের উপলব্ধি টুকু ব্যক্ত করলাম।
বেগম খালেদা জিয়া তার দীর্ঘ আপোসহীন লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তিনি চান বা না চান, অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে তাকে জনগণ পাক বা না পাক, বেগম জিয়ার প্রতীকী তাৎপর্য আগামী রাজনীতিকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করতে পারে। এর আগে আমি বলেছি, তার আপসহীনতা, অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট শক্তি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন না করা, তাকে এক ঐতিহাসিক মর্যাদা দিয়েছে, তা আর বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনগণের স্মৃতিতে আর ম্লান হবার নয়। এই দিক থেকে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সাক্ষাৎকার নিছকই সৌজন্য হলেও তার ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পরিবেশ তৈরির আন্তরিক প্রয়াস। এই সাক্ষাৎকার খুবই সময়োপযোগী হয়েছে। বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের ফল কী দাঁড়াবে সেটা নির্ভর করবে মোটাদাগে রাজনীতির তিন ত্রিভূজ পক্ষের মধ্যে সমঝোতা কিংবা বিরোধের মাত্রা দ্বারা। এই তিন পক্ষ কারা?
এক. গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্র-জনতার শক্তি এবং গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়ের রূপ কী হতে পারে সেটা তারা কতোটা জনগণকে সঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে ও ব্যাখ্যা করতে পারছে তার ওপর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ‘ঘোষণা’ কিংবা ‘ইশতেহার’ এই দিক থেকে বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এর আগের খসড়া বাজারে চাউর হয়, যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এর প্রণয়ন ওপর থেকে চাপিয়ে নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ছাত্র-তরুণদের আবেগ তাড়িত হয়ে চললে তারা ব্যর্থ হবে। দরকার ইতিহাস, রাজনৈতিক মতাদর্শিক তর্ক মীমাংসা এবং পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের যুগে নিউ লিবারাল ইকোনমিক পলিসি এবং তথাকথিত লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শ মোকাবিলার শক্তি অর্জন। কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয় সেটা সকলকেই বুঝতে হবে। ছাত্র-তরুণদের প্রমাণ করতে হবে তারা সমাজের দায়িত্বশীল ও গাঠনিক শক্তি।
দুই. বিএনপি এবং তার জোট ও সমর্থক। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে স্বকার এবং প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা বহু জটিল সমস্যার সমাধান সহজে করতে পারি।
তিন. সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি এবং রাষ্ট্র সুরক্ষার প্রচলিত আদর্শ ও ভূমিকা জাতীয় রাজনীতিতে সদাসর্বদা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে ছায়া ফেলে। ৩ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। আগামীতে যেন তারা এই গুরু দায়িত্ব পালন করে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
বলাবাহুল্য এই ত্রিভূজের বাইরেও জমায়াতে ইসলামীসহ অন্য ইসলামী দল রয়েছে। তবে ইসলামপন্থী দলগুলো জাতীয় রাজনীতির নির্ধারক বয়ান নির্মাণে এখনও পিছিয়ে রয়েছে। ছাত্র-তরুণদের রাজনীতি সেকুলার বনাম ধর্মীয় মতাদর্শের বাইনারি ভেঙে নতুন রাজনৈতিক বয়ান তৈরির শর্ত হাজির করেছে। তারা এই নতুন রাজনৈতিক পরিসর গড়ে ওঠায় উপকৃত। তারা নিজেদের স্বার্থেই ছাত্র তরুণদের অনুসরণ করবে। তাই বলা যায়, মোটা দাগে এই তিন পক্ষের সমঝোতা কিংবা বিরোধ আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ণয় করবে।