খুলনা | বুধবার | ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | ২৩ মাঘ ১৪৩১

ভাষা আন্দোলনের দিনগুলি

নিজস্ব প্রতিবেদক |
০২:০৫ এ.এম | ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫


বাঙালি মুসলমানদের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগে অবাঙালি মুসলিমরা তাদের বুঝান যে, উর্দু ইসলামী ভাষা। ফলে ১৯৪৭-এর আগে থেকেই অনেক বাঙালি মুসলিম উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করতে থাকেন। অথচ ইসলামের সাথে উর্দু বা ফারসি ভাষার কোনোরূপ বিশেষ সম্পর্ক নেই। উর্দুও বাংলার মতই একটি ভারতীয় ভাষা। তবে বাংলা ভাষা উর্দুর চেয়ে অনেক বেশী উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা। তবুও প্রতারণামূলক ভাবে এরূপ দাবি করা হয়। অনেক আলিম, মুসলিম রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতা এরূপ দাবির প্রতিবাদ করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অবশ্যই বাংলা হতে হবে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পরও এ বিষয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও অন্যান্য সংস্থা ও ব্যক্তি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জোর দাবি জানান, যা এদেশের মানুষের গণ-দাবিতে পরিণত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এ দাবির পক্ষে ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিনের বক্তৃতার পর কয়েক দিন মিছিল-মিটিং ধর্মঘটের পর আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেট ল্যাংগুয়েজ কমিটি ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্র“য়ারি সারাদেশে বাংলা ভাষার দাবির পক্ষে হরতাল ও মিটিং করার আহŸান জানায়। খুলনায়ও সে আবেদন পৌঁছায় কিন্তু তৎকালীন নেতৃবৃন্দ কেউ এগিয়ে আসেন না। এম এ গফুর তখন ছাত্র জীবনের শেষ পর্যায়। থাকেন মিউনিসিপ্যাল পানির ট্যাংকের বিপরীত দিকে যশোর রোড ও সারদা বাবু রোডের (বর্তমান আহসান আহমেদ রোড) সংযোগ স্থলে কাঁচা ড্রেনের উপরে সেনহাটির শচীন সেনের জীর্ণ একতলা বাড়ির একটি কামরায়। বাড়িটি পরিত্যক্ত বললেও চলে। পাশের কামরায় এ কে সামসুদ্দিন “আজাদ গ্রন্থালয়” নামক একটি ছোট লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করে চালাচ্ছেন। সেখানে পাড়ার ছেলেরাতো বটে দু’চার জন বয়স্ক ব্যক্তিও বই, খবরের কাগজ পড়তে আসেন। কিশোর সুনু মিয়া ইতোমধ্যে পাড়ার মুরব্বীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ২১ ফেব্র“য়ারি কর্মসূচি পেয়ে এম এ গফুর, সুনু মিয়া ও ছাত্রনেতা তোফাজ্জেল হোসেনকে নিয়ে আলোচনায় বসে ভাবছিলেন কি করা যায়। ‘১৮ তারিখে’ তিনজনের আলোচনা। এমন সময় এম এ বারী এসে পৌঁছান, ঐ চারজন মিলে সাব্যস্ত করেন শহরব্যাপী পোস্টারিং ও স্কুল কলেজে ধর্মঘট করার, পোস্টার তৈরির কাগজ চাই, কলম চাই, লেখার লোক এবং এসব গোপন রাখতে হবে সরকারের নজর থেকে। ক্লাবে ছিল কয়েকখানা খবরের কাগজ। সুনু মিয়া যোগাড় করল আরও কয়েকখানা। দু’আনা দিয়ে আলতা কেনা হলো এক শিশি, বাঁশের চটায় ন্যাকড়া পেচিয়ে তৈরি করল তুলি। তাই দিয়ে ওরা ১০০ খানার মত পোস্টার লিখে ফেলল এবং ২০ তারিখের সন্ধ্যায় রাতের অন্ধকারে যশোর রোড, কেডি ঘোষ রোড ও স্কুলগুলোর দেওয়ালে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল। পরদিন ঐ চারজনসহ আরও কয়েকজন স্কুলে-স্কুলে গিয়ে ক্লাস বর্জনের আহŸান জানায়। ২১ ফেব্র“য়ারি বি কে ইনস্টিটিউট, মডেল স্কুল ও সেন্ট যোসেফ স্কুলের ছেলেরা হরতালে অংশ নেয়ার পাশাপাশি মিছিলে যোগ দেয়। ঐদিনের প্রোগ্রাম ওখানেই শেষ। স্কুলগুলোতে কোন রকম সাড়া পেলেও বৃহৎ শহরবাসীর মনে বিশেষ কোন দাগ কাটেনি। দৌলতপুর কলেজে মিজানুর রহিম, জাহিদুল হক, নুরুল ইসলাম নান্নু, মালিক আতাহার প্রমুখের নেতৃত্বে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পরদিন ২২ ফেব্র“য়ারি শোনা গেল ঢাকায় মিছিলের উপর গুলি হয়েছে এবং অনেক ছাত্র মারা গেছে। ঢাকা-খুলনার একমাত্র যোগাযোগ পুলিশ লাইনে রক্ষিত ওয়্যারলেস। আর এর মাধ্যমে ঢাকার সরকারি কর্তৃপক্ষ ঢাকার গুলি হওয়া ও কিছু ছাত্রের মৃতজনিত উক্ত পরিস্থিতি উলে­খ করে জেলা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়। ঐ সংবাদ একজন ওয়্যারলেস অপারেটরের মাধ্যমে খুলনা শহরে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এ সংবাদ পাওয়ার পর আব্দুল গফুর সাহেবের আস্তানায় হাজির হন যুবনেতা আবু মুহম্মদ ফেরদৌস, এফএমএ জলিল ও এম নুরুল ইসলাম। এ সময় গফুর সাহেবের প্রচেষ্টায় আন্দোলনে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন তারা। ওদের দেখাদেখি দল ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে বিশেষ করে মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা আবু মুহম্মদ ফেরদৌস এসে আন্দোলনের গতি অনেক সজীব করে দেন।