খুলনা | শুক্রবার | ০৯ মে ২০২৫ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মূল চালিকাশক্তি’

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনায় মনে হয় রাজনীতিবিদরা অপাঙ্ক্তেয় : মির্জা ফখরুল

খবর প্রতিবেদন |
০১:৫৮ এ.এম | ২৩ মার্চ ২০২৫


অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে। এ ছাড়া সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, রাজনীতিবিদরা অপাঙ্ক্তেয় এবং অনির্বাচিত লোকদের দিয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই শ্রেয়। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যতটা সম্ভব অবমূল্যায়ন করা এবং ক্ষমতাহীন করাই উদ্দেশ্য, যার ফলশ্র“তিতে একটি দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
শনিবার বিএনপি’র চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের জনগণ অপেক্ষায় রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘গণতান্ত্রিক শক্তির অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী, এসব প্রস্তাবের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য একটি নির্বাচিত সংসদই উপযুক্ত ফোরাম। ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মূল চালিকাশক্তি। এই ঐক্য অক্ষতুœ রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার বিকল্প নেই।’
মির্জা ফখরুল সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না, যা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য ও গণঐক্যে ফাটল ধরাবে। সুতরাং, অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কোনো পক্ষ যেন রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।’
বর্তমানে আলোচিত বিষয় ‘সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে’—এই বিতর্ককে ‘অনাবশ্যক’ উল্লে¬খ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার ও নির্বাচন দ’টোই একসঙ্গে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘সংস্কার সনদ’ প্রণয়ন করা যেতে পারে, যা নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় হলো, প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুত একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।’
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু উপদেষ্টার রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার কারণে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনকে ব্যবহার করার লক্ষণ ও প্রমাণ ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।’
বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ও সুপারিশমালা নিয়ে দলীয় পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পাঠানোর ¯েপ্রডশিটে যে অপশন বা পছন্দগুলোর ঘরে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়েছে, তাতে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে যে, যে বিষয়গুলো প্রস্তাব আকারে আসতে পারতো তা প্রস্তাব না রেখে লিডিং কোশ্চেন আকারে হ্যাঁ, না, উত্তর দিতে বলা হয়েছে। যেমন-প্রস্তাবগুলো গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চাই কি না। হ্যাঁ অথবা না বলুন। কিন্তু প্রথমে সিদ্ধান্ত আসতে হবে যে, গণপরিষদের প্রস্তাবে আমরা একমত কি না। একইভাবে ‘গণভোট’, ‘গণপরিষদ ও আইন সভা’ হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন চাই কি না ইত্যাদি হ্যাঁ/না বলুন।
সংবিধানের ‘প্রস্তাবনার’ (চৎবধসনষব) মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে থাকলেও তা ¯েপ্রডশিটে উল্লেখ করা হয়নি। ¯েপ্রডশিটে ৭০টির মতো প্রস্তাব উল্লেখ করা হলেও মূল প্রতিবেদনে সুপারিশের সংখ্যা ১২৩টির মতো।
একই ভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মূল প্রতিবেদনে ১৫০টির মতো সুপারিশ তুলে ধরা হলেও ¯েপ্রডশিটে মাত্র ২৭টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই সংবিধান সংস্কারের সঙ্গে সংশ্লি¬ষ্ট। তাই আমরা মনে করছি, ¯েপ্রডশিটের সঙ্গে মূল সুপারিশমালার ওপর আমাদের মতামত সংযুক্ত করে দিলে বিভ্রান্তি এড়ানো যাবে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ¯েপ্রডশিটের অবস্থা এবং কমিশন সদস্যদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও বিশেষ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে মিল পাওয়া যায়, যাতে জনমনে প্রশ্নের জন্ম হতে পারে যে, সব বিষয় যেন একটি পূর্বনির্ধারিত কর্মপরিকল্পনার অংশ, যা গণতন্ত্রের স্বার্থের পক্ষে কি না, বলা মুশকিল। সুপারিশমালাসমূহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, এতে ভবিষ্যতে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োগের অযৌক্তিক প্রচেষ্টা রয়েছে, যা অনভিপ্রেত।
সুপারিশমালায় সাংবিধানিক কমিশনসহ (এনসিসি) নতুন নতুন বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সমস্ত কমিশনের এখতিয়ার, কর্মকাণ্ডের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে যতটা সম্ভব আন্ডারমাইন করা এবং ক্ষমতাহীন করাই উদ্দেশ্য, যার ফলে একটি দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের মালিকানার প্রতিফলন হয় নির্বাচিত সংসদ ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কিন্তু সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনীতিবিদরা অপাঙ্ক্তেয় এবং অনির্বাচিত লোকদের দিয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই শ্রেয়।
বিএনপি মহাসচিবের মতে, জনগণের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি এবং ধর্মবোধ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বিভিন্ন সংস্কার ও সাংবিধানিক সংশোধনী প্রণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য ধরে রেখে, দীর্ঘ ১৬ বছরের আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের শহিদদের স্বপ্ন অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।’
বিএনপি’র মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ফ্যাসিবাদ বিরোধী রক্তঝরা আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়। অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার ভিত্তিক এবং বৈষম্যহীন একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য দেশের জনগণ অপেক্ষায়।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্র, জনগণের মালিকানার প্রতিফলন হয় নির্বাচিত সংসদ এবং জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কিন্তু সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, রাজনীতিবিদরা অপাংক্তেয় এবং অনির্বাচিত লোকদেরই দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করাই শ্রেয়।
লিখিত বক্তব্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ফ্যাসিবাদ উত্তর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে নানা প্রস্তাব আর মতামত উঠে এসেছে সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের মাধ্যমে, যার মূল ভিত্তিটা রচনা করেছে বিএনপি ৩১ দফা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের অনেক আগে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অন্তর্ভুক্তিমূলক বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত এবং বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সংস্কার প্রস্তাবগুলোর সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি প্রদানের জন্য একটি নির্বাচিত সংসদই কেবল উপযুক্ত ফোরাম। বিদ্যমান ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য এ দেশ এবং দেশের মানুষের মূল চালিকা শক্তি। এ ঐক্যকে অক্ষুণœ রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এ ঐক্যের চর্চাকে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত করতে হবে। আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না যাতে করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্য এবং গণঐক্য বিনষ্ট হয় অথবা ফাটল ধরে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখতে হবে। কোনো মহলকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি বলেন, সংস্কারের উদ্দেশ্য হলো, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, জনসাধারণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এবং জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা। সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা।
লিখিত বক্তব্য তিনি আরও বলেন, সংস্কার আগে-নির্বাচন পরে, কিংবা নির্বাচন আগে-সংস্কার পরে এ ধরনের অনাবশ্যক বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। যেহেতু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া দু’টোই একই সঙ্গে চলতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি সংস্কার সনদ তৈরি হতেই পারে, নির্বাচিত সরকার পরবর্তীতে যা বাস্তবায়ন করবে।