খুলনা | বৃহস্পতিবার | ২৪ এপ্রিল ২০২৫ | ১১ বৈশাখ ১৪৩২

অনিয়ম দুর্নীতি নারী কেলেঙ্কারী নিয়োগ বাণিজ্যের পর এবার কপিলমুনি মহিলা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে লাঞ্ছনার অভিযোগ

পারভেজ মোহাম্মদ |
০২:১৭ এ.এম | ২৪ এপ্রিল ২০২৫


“আমি যা কিছু করি না কেন তোমরা আমাকে কিছুই করতে পারবানা। আমার একটা লোম সোজা করার ক্ষমতা তোমাদের নাই।” একজন নারী সহকর্মীকে এমনিতর অশালিন ও আপত্তিকর মন্তব্য করেন দাম্ভিক অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার। মানসিক নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গালিগালাজ ও চরম অসদাচরণের অভিযোগ তুলে এবার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার মহিলা শিক্ষকবৃন্দ। 
গতকাল দাখিল পরীক্ষায় কক্ষ প্রত্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালনে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে আবেদন করার পরও অধ্যক্ষের গালিগালাজ ও লাঞ্ছনার শিকার হন মাদ্রাসার গণিত শিক্ষক হোসনেয়ারা খাতুন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসার ৬ জন মহিলা শিক্ষক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন বলেন, আমার কাছে উনারা এসেছিলেন। বিষয়টি শুনেছি, দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 
লিখিত অভিযোগ পত্রে তারা উলে­খ করেন, অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার আপাদমস্তক দুর্নীতি পরায়ণ ও চরিত্রহীন ব্যক্তি। অভিযোগ পত্রে  মাদ্রাসায় কর্মরত অফিস সহায়ক আয়ার সাথে অধ্যক্ষের দীর্ঘদিনের অনৈতিক সম্পর্কের কথা উলে­খ করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষক কাকুলি টিকাদার অফিস কক্ষে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে গেলে অধ্যক্ষ ও আয়ার আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলার পর থেকে তাকে সহ মাদ্রাসার অন্যান্য মহিলার শিক্ষকদের সাথে নানাভাবে অসদাচরণ ও মানষিক নির্যাতন করতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২৩ এপ্রিল সকাল বেলা দাখিল পরীক্ষায় কক্ষ প্রত্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন না করায় হোসনেয়ারা খাতুন কে অফিস কক্ষে ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও লাঞ্ছিত করে। শত শত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের সামনে লাঞ্ছিত হওয়ার পর শিক্ষক হোসনেয়ারা খাতুন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত অন্যান্য সহকর্মীরা তাকে সাথে নিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। অবশ্য অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার। ইতোপূর্বে অধ্যক্ষের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অসদাচরণের অভিযোগ তুলে সভাপতি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, মহাপরিচালক, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, রেজিস্ট্রার, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ। 
এর আগে গত ২৬ ফেব্র“য়ারি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) ও সভাপতি, কপিলমুনি জাফরউলিয়া মাদ্রাসা বরাবর লিখিত অভিযোগ থেকে জানা গেছে, অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার এর বিতর্কিত নিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে মাদ্রাসায় কর্মরত। আব্দুস সাত্তার অত্র মাদ্রাসায় ইফতেদায়ী ক্বারী হিসেবে চাকুরিরত অবস্থায় ১৯৮৯ সালে আলিম, ১৯৯১ সালে ফাজিল এবং ১৯৯৩ সালে নিয়মিত পরীক্ষার্থী হিসেবে কামিল পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে ১৫ জানুয়ারি এই প্রতিষ্ঠানে আরবি প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এর মাত্র ছয় মাস পরে লাউড়ি রামনগর কামিল মাদ্রাসায় ১৯৯৪ সালের  ১ সেপ্টেম্বর প্রভাষক পদে যোগদান করেন এবং ১৯৯৭ সালের ১৬ নভেম্বর অব্যাহতি নেন। এরপর ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ অর্থাৎ ১৬ মাস পরে আবারো কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসায় আরবি প্রভাষক পদে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এই প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসাবে বিতর্কিত নিয়োগ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। যা ২৪ অক্টোবর এর নীতিমালা অনুযায়ী (৬ মাস অতিবাহিত হলে ব্রেক অফ সার্ভিস হবে) ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা পূর্ণ না হওয়ায় অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভ করেন। অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে আব্দুস সাত্তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অসদাচরণ ও নারী কেলেঙ্কারির সাথে নিজেকে জড়িয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মাদ্রাসার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের নামে ২৯ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। মাদ্রাসার অফিস সহকারীর নিকট সংরক্ষিত খাতাপত্র অডিট করে পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ পত্রে উলে­খ রয়েছে। বিষয়টি তৎকালীন সভাপতি ও এডিসি রাজস্ব খুলনা, মুকুল কুমার মৈত্র, অধ্যক্ষের দাখিলকৃত মাদ্রাসা উন্নয়নের নামে ৪০ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯০৯ টাকা ঋণ দেখিয়ে রেজুলেশন প্রস্তুত করলে সভাপতি উক্ত রেজুলেশন এর হিসাব সংক্রান্ত অংশ কেটে দেন এবং আভ্যন্তরীণ অডিট প্রতিবেদন জমা প্রদানের নির্দেশ দেন। এছাড়া অধ্যক্ষ সরকার প্রদত্ত পিবি জিএসআই অনুদানের ৫ লক্ষ টাকা গভর্নিংবডি বা শিক্ষকদের কাউকে কিছু না জানিয়েই নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খরচের ভাউচার জমা না দেওয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ভাউচার জমা না দেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা প্রকাশ করেছেন তার চতুর্থ তাগিদাপত্রেও অত্র প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। 
জানা গেছে, অত্র মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কাছ থেকে এমপিওভক্তি, বিএড স্কেল, উচ্চতর স্কেল ও বেতন করানোর নামে বিভিন্ন সময় অবৈধ ভাবে হাজার হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার। এনটিআরসিএ থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত প্রভাষক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে সভাপতি, রেজুলেশন বাবদ এবং বেতন করানোর নামে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও কর্তা ব্যক্তিদের দেওয়ার কথা বলে হাজার হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। এমনকি মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের আয়তন বৃদ্ধির জন্য স্বল্পমূল্যে জমি ক্রয়ের সময় দাতাদের ভুল বুঝিয়ে সাড়ে চার শতাংশ জমি নিজের নামে লেখার অভিযোগ রয়েছে এই পত্রে। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে জমিদাতারা আন্দোলনের হুমকি দিলে মাদ্রাসার জমি এক সপ্তাহের মধ্যে মাদ্রাসায় ফেরত দিবেন মর্মে লিখিত শর্তে স্বাক্ষর করেও অদ্যবদি তা ফেরত দেননি। সর্বোপরি অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের সাথে মাদ্রাসার আয়ার গোপন প্রনয়ের বিষয়টিও আবেদনে উঠে এসেছে। শিক্ষক-কর্মচারী এর মধ্যে মোঃ মুজিবুর রহমান, এম এম জমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী হুসাইন, মোঃ শরিফুল ইসলাম, ফারহানা জাহান, নাজনীন সুলতানা, আব্দুল বাসেত, মোঃ ইউসুফ আলী, মোঃ হাসান আলী, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, কাকুলি টিকাদার, হোসনেয়ারা খাতুন, শিউলি রানী, সুরাইয়া খাতুন, মোঃ সরোয়ার খান, আনোয়ার সাদাত, মেহেদী হাসান, মোঃ মারুফ বিল­াহ, এস কে মিজানুর ও শেখ মাসুদুজ্জামান স্বাক্ষরকৃত এই অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ এর অফিস কক্ষে রক্ষিত শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে গেলে অধ্যক্ষ ও আয়ার আপত্তিকর অবস্থানের কারণে শিক্ষকদেরই বিভিন্ন সময় লজ্জায় পড়তে হয়েছে। উলে­খ্য অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি, জমি আত্মসাৎ ও মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে অবৈধ ঝাড়ফুঁক ব্যবসা পরিচালনার প্রতিবাদে ২০২৫ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি জমি দানকারীর পরিবার পরিজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী মানববন্ধন করেন। ইতোপূর্বে অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগে কপিলমুনি ইউনিয়ন পরিষদের সালিশি বৈঠকে তৎকালীন সময়ে আর্থিক জরিমানা ও তিরস্কারের ঘটনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। 
গতকার বুধবার মহিলা শিক্ষক লাঞ্ছিতের মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কর্মচারী ও এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ ক্লাস বর্জনের মত কর্মসূচি আসতে পারে বলে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ ও বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী জানিয়েছেন।