খুলনা | বৃহস্পতিবার | ০১ মে ২০২৫ | ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মে দিবসের ঘোঘণা ও শ্রমিকদের অধিকারের স্বীকৃতি

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী |
১২:০১ এ.এম | ০১ মে ২০২৫


“মনের স্বাধীনতা রক্ষা করতে না পারলে তোমাতে ও পশুতে প্রভেদ থাকবে না, জীবন তোমার মিথ্যা হবে। স্বাধীন হৃদয় -সত্যের সেবক, কামার হও; সেও ভাল নিজেকে যন্ত্র করে ফেলো না। সৎ জ্ঞানী ও মহৎ যিনি, তিনি নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন করতে ভয়ঙ্কর লজ্জা বোধ করেন” -(মোহাম্মদ লুৎফর রহমান)। 
১ মে ১৮৮৬ সাল, শিকাগোর শ্রমজীবি মানুষের জন্য মালিক পক্ষের অন্যায় অপেক্ষা অবিচারের বিরুদ্ধে রচিত হয়েছিল শোষিতদের রক্তে রঞ্জিত এক প্রতিবাদী ইতিহাস। সত্য ও ন্যায় অপেক্ষা উপরিস্থিত মনিবদের ভাবাদর্শন শ্রমজীবী মানুষের জন্য অবশ্যই পালনীয় শর্ত, এরূপ অমানবিক ও অযাচিত মতাদর্শন সে দিনে শ্রমজীবি মানুষ নিঃসংকোচে মেনে নিতে পারেনি। অপর পক্ষে মনের স্বাধীনতা ও ইচ্ছা যে কোন পেশি শক্তিকে পরাভূত করতে পারে,তার জলন্ত স্বাক্ষর মেলে ১ মে ১৮৮৬ তে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে। সে দিন কুচক্রী মহল শ্রমিকদের ন্যায্য নির্ভেজাল ও শ্বাশত নিটোল বাস্তবতার নিরিখে যৌক্তিক দাবিকে ঠুনকো দাবিতে পরিণত করতে পারেনি। বরং ক্ষমতাধরেরা সে দিন শ্রমজীবী মানুষের অদম্য আপোসহীন শক্তিকে ক্ষমতার বুলডোজারে নিষ্পেষিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল ।
তদুপরি শ্রমজীবী মানুষের সত্যের সংগ্রাম মহীরুহ রূপ নিয়ে বীরদর্পে সমর্থ্য হয়েছিল শোষক শ্রেণির অহমিকার কাল নেকাবকে নু’য়ে দিতে। ফলশ্র“তিতে নিপীড়িতদের হাহাকার এবং শ্রমিকদের আত্মহুতির মধ্য দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নতুন আঙ্গিকে রচিত হয়েছিল আজকের দিনটি মে’ দিবস হিসেবে। সে দিন হে’ মার্কেটে ন্যায্য শ্রমের দাবিতে শ্রমিক আন্দোলনের মাঝে যে বোমাটি ফেটেছিল তা নিয়োগকর্তার ভাড়াটের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল; শ্রমিকদের দ্বারা নয়। ঐদিন শ্রমজীবী মানুষের আট ষন্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে বোমা বিস্ফোরণে ৭ জন পুলিশ অফিসার ও কয়েকজন শ্রমিক নিহত হন। শ্রমিকদের উপর বোমা ফোটানোর দায় দিয়ে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। প্রহসমূলক এ বিচার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন পক্ষের একচেটিয়া প্রভাব কায়েম করায় আত্মস্বার্থ চরিতার্থমূলক এ বিচারিক প্রক্রিয়ায় অবশেষে অন্যায়ভাবে শ্রমিকনেতা স্পাইজ, পার্সনসের, মার্টিনসন সহ ৬ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়। সম্ভবত: ন্যায্য শ্রমের দাবিতে পূর্বে এরূপ করুণ নির্যাস ইহিহাসে আর কখনো রচিত হয়নি। এরপর ১৮৮৯সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে’ কে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২৩ সালে মাদ্রাজের সমুদ্রকূলে ভারত উপমহাদেশের শ্রমজীবী মানুষেরা প্রথম ‘মে’ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯২৬ সালের পাকিস্তানের লাহোরে এবং ১৯২৯ সালে বাংলাসহ সারা উপমহাদেশে ১ম’- কে মে দিবস হিসেবে উদযাপন করা শুরু হয়।  
মানুষ পৃথিবীতে সুস্থ সাবলীল জীবনের তাগিদে সমাজ রচনা করেছে। সেই সমাজে নিগৃহীতদের মানবাধিকার লংঘন পূর্বক যারা অবাঞ্ছিত সমাজ ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটিয়ে ঘৃণ্য ও বঞ্চনার নীরন্ধ্র অন্ধকারে শ্রমিকদের পাপারাস্যি (সমাজের ঘৃন্য কীট) সদৃশ্য রেখে শোষণের রুদ্র বীণার ঝংকার তুলেছে, সে বাধার বিন্ধ্যাচল একদিন না একদিন তো পরাভ‚ত হবেই। মহাকালের নির্মম অঙ্গুুলি হেলনে শোষিত শ্রমব্যবস্থার একদিন বিদূরিত হয়েছিল। ফলশ্র“তিতে মিলনকামী মহাকালের অন্তিম স্বদিচ্ছায় পঙ্কিল ও ভেদক্লিষ্ট শ্রম ব্যবস্থার বিদায় পূর্বক ১ মে ১৮৮৬ সালে আমাদের মাঝে সর্বজনীন মহামিলনের পরম লগ্ন সমাগত হয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল বৈষম্য বিদুরিত তথা শ্রমভিত্তিক সেক্যুলারিজমের এক সমাজ ব্যবস্থা। 
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রাম স্মরণে শ্রদ্ধার সঙ্গে মর্যাদা দানের প্রেক্ষিতে ‘মে’ দিবসকে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিবস হিসেবে ঘোষণা শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্ত¡ রক্ষার দলিলের স্বীকৃতি স্বরুপ। সেদিন শোষিতদের সত্বা ও অস্তিত্বের এক অপরিহার্য ও অমোষ অবলম্বন ‘মে’ দিবসের অঙ্গিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে জাতীয় চেতনায় বিশ্ব বিবেককে প্রকম্পিত করেছে। এতে করে শ্রমজীবী মানুষকে জাতীয় সত্ত¡ায় সামগ্রীক উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে জাতীয় শক্তিকে সমুজ্জ্বল করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সা¤প্রতিক বিশ্বে প্রবল শক্তিধরদের ক্ষমতায়ন যেমন সত্য তেমনই দুর্বল ও শোষিত গোষ্ঠিগুলোর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রয়াস ও উপেক্ষা করার মত নয়। সেদিন ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাপি ’মে’ দিবস পালনের ঘোষণা দুর্বল গোষ্ঠিগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার প্রয়াসের চিত্রকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিবে-এমনটি ভাবা যদিও সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত নয়, তথাপি আমরা বলতে পারি শোষিত গোষ্ঠিগুলো অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যতই দুর্বল হবে শোষক গোষ্ঠির আগ্রাসন তত ব্যাপক ও তীব্রতর হবে। সে দিক দিয়ে বিচার করলে বলতে পারা যায়, শোষিত গোষ্ঠিগুলোর স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার রক্ষার প্রয়াসের প্রতি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনের সে দিনের সমর্থন দুর্বল গোষ্ঠিগুলোর স্বজাতীয় ভাবধারা ও অধিকার রক্ষার সময়োপযোগী বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত যা ভূয়সী প্রশংসার দাবিদারও বটে।  
লেখক: সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা।