খুলনা | রবিবার | ০৪ মে ২০২৫ | ২১ বৈশাখ ১৪৩২

এপ্রিল মাসে প্রাণ গেল ৩০ জনের, দু’দিনে ১৩

বজ্রপাত : তালগাছ প্রকল্প ব্যর্থ, নতুন উদ্যোগে সচেতনতায় জোর

খবর প্রতিবেদন |
০১:২০ এ.এম | ০৪ মে ২০২৫


দেশে বজ্রপাত বাড়ছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অনেক বেশি। গেল বছরে দেশে বজ্রপাতে ২৯৭ জন নিহত হয়েছেন। চলতি বছরও মৌসুমের শুরুতেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গত রোববার থেকে সোমবার পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে বজ্রপাতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিল মাসে বজ্রপাতে মারা গেছেন ৩০ জন।
আবহাওয়া অধিদফতর শুক্রবার দেশের তিন জেলায় বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে। জেলাগুলো হলো বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট। বৃহস্পতিবার বজ্রপাতের পূর্বাভাস ছিল দেশের আট জেলায়। জেলাগুলো হলো: ঢাকা, শেরপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ এবং সিলেট।
আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মোঃ আবুল কালাম মল্লিক জানান, ১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে বজ্রপাতের সতর্কতা দেওয়া শুরু হয়েছে। এর আগে এই সক্ষমতা ছিল না। তিনি বলেন, আমরা দুই থেকে চার ঘণ্টা আগে এখন এই সতর্কতা দিতে পারি। আমরা উন্নত গাণিতিক মডেল, লাইটনিং ডিটেক্টর এবং জাপানের ইউমোরি স্যাটেলাইটের ডাটা বিশ্লেষণ করে এ্যালার্ট দিচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন গড়ে প্রতি বছর ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যান। প্রচুর গবাদি পশুও মারা যায়। ২০১৬ সাল থেকে বজ্রপাতকে বাংলাদেশে দুর্যোাগ ঘোষণা করা হয়েছে।
‘বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রমেঘের এলাকার পরিবর্তন ঘটেছে। উঁচু গাছপালা কেটে ফেলার কারণে এখানে বজ্রপাতে মৃত্যু বাড়ছে। আর একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদনের কারণে অধিকাংশ সময় মাঠে থাকায় কৃষকরা  এর শিকার হচ্ছেন বেশি। বজ্রপাত উঁচু জায়গায় আঘাত করে নিষ্ক্রিয় হয়। মাঠে বা খোলা জায়গায় গাছপালা না থাকায় কৃষক, গবাদি পশু, পথচারিদের আঘাত করে,’ বলেন তিনি।
পরিবেশ ও বজ্রপাত বিষয়ক গবেষক এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির সহেযোগী অধ্যাপক ড. ফেরদৌস আহমদে বলেন, ‘মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেক্সাস ও ফ্লোরিডায়ও অনেক বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার কিছু এলাকায়ও বজ্রপাতের হার অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে তাদের ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম। এর কারণ হলো, ওরা  আগেই পূর্বাভাস দিতে পারে। ওই এলাকাগুলো আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নয়। আর লাইটনিং অ্যারেস্টার অনেক বেশি। তাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচিও অনেক এগিয়ে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা নাই।’
তার কথা, ‘আমাদের এখানে শহরের চেয়ে গ্রামে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি। কারণ, শহরে উঁচু ভবন আছে। আর ভবনগুলোতে প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। কিন্তু গ্রামে ফাঁকা জায়গা, খোলা মাঠ, ফসলের মাঠ অনেক বেশি। সেখানে আবার এখন উঁচু গাছ নাই। ফলে বজ্রপাতের সময় মাঠে থাকা কৃষক, গবাদি পশু, পথচারী এর শিকার হন।’ ‘আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে নাইট্রোজেন বেশি নিতে পারছে মেঘ। নাইট্রোজেন যত বেশি নেবে, বজ্রপাত তত বাড়বে,’ বলেন তিনি।
দেশে বিগত সরকারের সময়ে বজ্রপাত নিরোধে সারাদেশে ৪০ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। এখন স্বল্প পরিসরে লাইটনিং অ্যারেস্টার লাগানো হয়েছে।
গবেষক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নাঈম ওয়ারা বলেন, ‘ওই তালগাছ লাগানো হয়েছিল রাস্তার দুই পাশে। মাঠের মধ্যে লাগানো হয়নি। কিন্তু সেটা তো তেমন কাজে আসেনি। আর রক্ষণাবেক্ষণও করা হয়নি। কারণ, বজ্রপাতে মাঠ ও খোলা জায়গায় যারা থাকেন, তারা এর শিকার হন। আর  লাইটনিং অ্যারেস্টার যা বসানো হয়েছে, তা-ও অপরিকল্পিত। লাগানো হয়েছে জেলা প্রশাসকের অফিস ভবনের উপরে। সেখানে আবার ওয়্যারলেস টাওয়ার আছে। সেটা অ্যারেস্টারের চেয়ে উঁচু। তাহলেও ওটা কী কাজে আসবে? ওখানে তো অ্যারেস্টার প্রয়োজন নাই। আবার মাঠে যা দেয়া হয়েছে, তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।’
তার কথা, ‘বজ্রপাত আগেও হয়েছে, মানুষ মারাও যাচ্ছে। আর এখন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কারণে রিপোর্টেড হচ্ছে বেশি। কিন্তু আমরা বজ্রপাতের যে প্রাকৃতিক নিরোধক, তা নষ্ট করে ফেলেছি। মাঠের পাশে বাবলা গাছ, তাল গাছ কেটে ফেলেছি। রেইনট্রি গাছ নাই। ফলে মাঠে যখন বজ্রপাত হয়, তখন কিন্তু সেখানে মানুষ আর গবাদি পশু ছাড়া উঁচু কিছু পায় না।’
‘মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিতে বজ্রপাতেরও প্রয়োজন আছে। মাছের উৎপাদনের জন্য দরকার। মাছের ডিমের জন্য দরকার। কারখানায় নাইট্রোজেন লাগে। বজ্রপাত নাইট্রোজেন উৎপাদন করে,’ বলেন তিনি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান জানান, বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু নিয়ে উদ্বেগ আছে। তাই এটা নিয়ে কাজ চলছে। তবে এখন পূর্বাভাস ও সচেতনতার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা এখন আবহাওয়া অধিদফতরের সঙ্গে সতর্কতা নিয়ে কাজ করছি। এখন যেহেতু বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, তাই আমরা আবহাওয়া অধিদফতরের ওই পূর্বাভাস সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে এই পূর্বাভাস সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আর জেলা প্রশাকদের মাধ্যমেও প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছি।’
‘সারাদেশে অ্যারেস্টার বসানোর একটা প্রকল্প নিয়ে আমরা কাজ করছি। অ্যারেস্টার বসালে সেটা সব সময় মেনটেইন করতে হয়। এর সঙ্গে মন্ত্রণালায় ও দাতারা যুক্ত আছেন। তারা এর সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। তার পরে সিদ্ধান্ত হবে,’ বলেন তিনি।
আবহাওয়াবিদ ড. মোঃ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলেই ভবন বা ঘরে আশ্রয় নিতে হবে। খোলা জায়গা, ছাতা বা গাছের নিচে আশ্রয় নেওয়া যাবে না। 
সূত্র: ডয়চে ভেলে।