খুলনা | বুধবার | ২১ মে ২০২৫ | ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অভিনব কায়দায় ব্যাংকে জালিয়াতি, মিশ্র প্রতিক্রিয়া

খুলনা শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের চেক ছিনতাইয়ের পর ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়েছে একটি চক্র

এন আই রকি |
০১:২১ এ.এম | ২১ মে ২০২৫


খুলনা শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ১০টি চেক এবং ১০২টি চালান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। চক্রটি ‘একাউন্ট পে’ চেকগুলো অভিনব কায়দায় ব্যাংকে নতুন নামে একাউন্ট খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে ৫টি চেকের টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এই ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একাউন্ট পে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অন্য কেউ কিভাবে ব্যাংক থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং এর পিছনে কার কার সহযোগিতা থাকতে পারে এমন প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সামনে জুন মাস এই মুহূর্তে অনেকেই কাজের বিল পাবে। এমন সময় এই দুর্ঘটনার কারণে অনেক ব্যবসায়ী চেক না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে অতিদ্রুত চক্রটিকে আটক করে টাকা উদ্ধার করা না হলে খুলনার শিক্ষাঙ্গণের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ থমকে যাবে। 
এদিকে গত ৬ মে নগরীর দৌলতপুর থানার খুলনা ফিলিং স্টেশনের অদূরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও থানায় চেকগুলো হারিয়ে গেছে মর্মে জিডি করা হয়। এ বিষয়ে বাদী এবং শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের কর্মচারী মোঃ আজগার হোসেন বলেন, নূরনগরস্থ এজি অফিস থেকে চেক এবং এমবি বইসহ ১০২টি চালান নিয়ে আসার সময় দুটি মোটরসাইকেলে চারজন গতিরোধ করে। মোটরসাইকেল থেকে দুর্বৃত্তকারীরা র‌্যাব-এর পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাকে বাইপাসে নিয়ে যায়। পরবর্তীকে টাকা পয়সা এবং চেকসহ সকল কাগজপত্র নিয়ে আজগরকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনা তিনি এসে অফিসে জানানোর পর দৌলতপুর থানায় গেলে সেখানে ছিনতাইয়ের বিষয়ে উলে­খ না করে চেক ও এমবি বইসহ চালান হারিয়ে গেছে মর্মে জিডি করেন। 
এই ঘটনার পর শিক্ষা প্রকৌশলী অফিস হিসাব বিভাগকে চেক হারানোর বিষয় জানানোর পর হিসাব বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৭ মে ইস্যুকৃত চেক অনুত্তোলন (নন-ড্রয়াল) করার জন্য মেইলসহ লিখিত আকারে চিঠি পাঠায়। কিন্তু কোন ভাবেই চেক ক্লিয়ারেন্স বন্ধ না হওয়ায় চক্রটি ছিনতাই হওয়া ১০টি চেকের মধ্যে ৫টি চেকেই ক্যাশ করে নেয়। এর মধ্যে মেসার্স রাফিদ ট্রেডার্সের ১২ লাখ ২৪ হাজার টাকার চেকটি অগ্রণী ব্যাংক কেডিএ শাখা থেকে ৮ মে, মেসার্স লুসি এন্টারপ্রাইজের ৭ লাখ ২৪ হাজার টাকার চেক রূপালী ব্যাংকের স্টেশন শাখা থেকে ১৪ মে, মেসার্স আলম কনষ্ট্রাকশনের দু’টি চেকের ১৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকার চেক কৃষি ব্যাংক কর্পোরেট শাখা থেকে ৮ মে, এবং এবি কনস্ট্রাকশনের ৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকার চেক কৃষি ব্যাংক কেডিএ শাখা থেকে ১৪ মে উত্তোলন করা হয়। অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা জানেই না তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে একাউন্ট পে চেকগুলো জালিয়াতি চক্রটি অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে উত্তোলন করে নিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ৬ মে চেক ছিনতাইয়ের ঘটনাটি দৌলতপুর থানায় সাধারণ জিডি কেন করা হয়েছিল এটা নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা রয়েছে। এছাড়া এজি অফিস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে জিডির বিষয় জানানোর পাশাপাশি মেইল এবং লিখিত ভাবে জানালেও ফোনে বিষয়টি জানিয়েছিল কি না এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক মেইল পেলেও তারা যথাসময়ে ব্যবস্থা নিয়েছে কি না বা নিলেও কিভাবে চেক ক্লিয়ারেন্স হলো তার সদুত্তোর নেই। সব থেকে বড় বিষয় ছিনতাই হওয়া চেকগুলোর বিপরীতে মাসুদ আলম নামে ফরিদপুরের যে যুবক বিভিন্ন ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছে তার ট্রেড লাইসেন্স এবং একাউন্ট ওপেন করার পর থ্যাংকস লেটার পাঠিয়ে বর্তমান ঠিকানা যাচাই করেছিল কি না তার উত্তর মেলেনি। এমনকি ছিনতাই হওয়ার পরের দিন একাউন্ট খুলে এত অল্প সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের চেক ক্যাশ হওয়ার বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা খুবই হালকা ভাবে দেখেছে।   
মেসার্স রাফিদ ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মোঃ রফিকুল ইসলাম  বলেন, চেক ছিনতাই হয়েছে ৬ মে। এর পরের দিন অগ্রণী ব্যাংকের কেডিএ শাখায় ফরিদপুরের বাসিন্দা মো মাসুদ আলম আমার প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে হিসাব খোলে। এরপর ৮ মে অগ্রণী ব্যাংকের স্যার ইকবাল রোড শাখা থেকে সেটা উত্তোলন করা হয়। একাউন্ট ওপেন করার সময় এবং টাকা নেওয়ার সময় ফুটেজ দেখেই পুরো ছিনতাইকারীসহ চক্রটিকে উদ্ধার করা সম্ভব। খুব দ্রুত ব্যবসায়ীরা টাকা না পেলে উন্নয়ন কাজে গতি কমে আসবে।
অগ্রণী ব্যাংকের কেডিএ নিউমার্কেট শাখা প্রধান মোঃ শরীফুল ইসলাম বলেন, গ্রাহকের এনআইডি যাচাই করে এবং ট্রেড লাইসেন্সের বার কোড যাচাইয়ের পর হিসাব খোলা হয়েছিল। তবে এটা জালিয়াতি করা হয়েছে কি না জানতাম না। আমাদের সকল প্রসেস সঠিক ছিল। 
খুলনার উপ বিভাগীয় হিসাব রক্ষক প্রকৌশলী নাসিফ কবির  বলেন, চেক হারিয়ে যাওয়ার বিষয় জানার পরপরই মেইলে এবং চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শাখায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। তবে এর পরে কিভাবে চেক ক্লিয়ারেন্স হয়েছে সেটা জানি না। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের খুলনার নির্বাহী পরিচালক শওকতুল আলম  জানান, এত বড় একটা বিষয় আমার জানা নেই। এজি অফিস মহানগরীর ভিতরে। আমাদেরকে কোন চিঠি বা ফোনেও বিষয়টি জানায়নি। 
খুলনার দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর আতাহার আলী জানান, প্রাথমিক ভাবে আমরা জেনেছিলাম চেক হারিয়ে গেছে। পরে অবশ্যই শুনেছি চেক ছিনতাই হয়েছে। এই বিষয়ে যদি মামলা করা হয় তবে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো।
খুলনা শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ গোলাম মুত্তাকিন জানান, আমার স্টাফ চেক নিয়ে এজি অফিস থেকে আসার সময় সেগুলো ছিনতাই হয়েছে। বিষয়টি থানায় জানানোর পর হারিয়েছে মর্মে জিডি করা হয়। পরবর্তীতে জিডির কপি আমরা এজি অফিসে পাঠাই। এজি অফিস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে মেইলের মাধ্যমে চেকের ক্লিয়ারেন্স স্টপের জন্য জানানোর পরও ৫টি চেক ক্যাশ হয়েছে। আমারা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি। আইনগত ভাবে চক্রটি ধরার জন্য কাজ শুরু হয়েছে।