খুলনা | শনিবার | ১৪ জুন ২০২৫ | ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রাজারহাটে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হতাশা, চামড়া ফেলে দিচ্ছেন ভৈরব নদে!

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর |
১২:৫৬ এ.এম | ১১ জুন ২০২৫


যশোরের রাজারহাট দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ চামড়ার মোকাম। একই সাথে এটি মৌসুমি চামড়া বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই হাটে এবার আর ব্যবসা নেই। ক্ষুব্ধ হয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ছাগলের চামড়া ভৈরব নদে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। আর কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন গরুর চামড়া। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে এ পরিস্থিতি বদলে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকারি নীতিনির্ধারণ, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বকেয়া আদায় না হওয়া ও অতিরিক্ত খরচের কারণে তারা দিন দিন হতাশ হয়ে পড়েছেন।
সরকার ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করেছে। খাসি ও বকরির চামড়ার দাম নির্ধারিত হয়েছে ২২-২৭ টাকা এবং ২০-২২ টাকা। কিন্তু মঙ্গলবার হাটে ছিল ভিন্ন বাস্তবতা। রাজারহাটে চামড়া মানভেদে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০০ থেকে ৯০০ টাকা পিস দরে, যা সরকার নির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম। এ নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম চামড়াহাট রাজারহাটের ব্যবসায়ীরা চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি না হওয়া, ট্যানারি মালিকদের বকেয়া পরিশোধে অনীহা, লবণের দাম বৃদ্ধি এবং শ্রমিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। হাটে তারা চামড়ার কেনা দামও পাচ্ছেন না। গরুর চামড়া তারা লস করে বিক্রি করছেন। এই হাটে একটি ছাগলের চামড়া ৪০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৯০০ টাকা পিস দরে। যা দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভ্যান ভাড়া বা শ্রমের মজুরি উঠছে না।
মঙ্গলবার ঈদুল আযহা পরবর্তী প্রথম হাট ছিল রাজারহাটে। সকাল থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা হাটে চলে আসেন। ইতোমধ্যে তারা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ শুরু করেছেন। তবে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যে তীব্র দর কষাকষি দেখা যাচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে অনেকেই চামড়া বিক্রি করতে দ্বিধায় পড়েছেন, কেউ কেউ আবার চামড়া ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
মুড়লি মোড় এলাকার মৌসুমি ব্যবসায়ী কামাল হোসেন জানান, তিনি চার হাজার ছাগলের চামড়া ও ২০০টি গরুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। লবণ মাখিয়ে সংরক্ষণ করেছেন সেগুলো। তবে তিনি আশঙ্কা করছেন যে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি নাও হতে পারে। সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কম দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এক সময় রাজারহাটে হাজারো মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করতেন। এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে বহিরাগত ব্যবসায়ীরা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হাসিব চৌধুরী বলেন, চামড়া ব্যবসায় এখন আর লাভ নেই। বড় ব্যবসায়ীরা দামে চাপে ফেলেন। ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চামড়া ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই হাটে ব্যবসা করছেন। কিন্তু ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে গত বছরের চামড়ার পাওনা টাকা এখনও পাননি। এ অবস্থায় এবারও চামড়া কেনার ক্ষেত্রে তার অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। তার মতে, ৩০০-৪০০ টাকার চামড়ায় লবণ, শ্রমিক ও পরিবহন খরচ যোগ করলে খরচ দাঁড়ায় ৬০০-৭০০ টাকা, অথচ ট্যানারিরা বেশি দামে কিনতে চায় না। এ কারণে ছাগলের চামড়া নিচ্ছেন না কেউ, রাস্তায় ফেলে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
মণিরামপুর এলাকার ব্যবসায়ী জগদীশ দাশ বলেন, তিনি এখন আর রাজারহাটে চামড়া বিক্রি করতে আসেন না। বরং ভালো রাস্তার কারণে সরাসরি ঢাকায় চামড়া পাঠান।
চামড়ার বাজার স্থিতিশীল রাখতে যশোর জেলা প্রশাসন ৩৭৭টি লিল­াহ বোর্ডিংয়ে ২.৫ মেট্রিক টন লবণ বিনামূল্যে দিয়েছে। কিন্তু যশোর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আকিল আহমেদ অভিযোগ করেন, এই লবণ অনেকেই চামড়ায় ব্যবহার না করে আলাদাভাবে বিক্রি করেছেন।
আকিল আহমেদ আরও বলেন, ট্যানারি মালিকরা বাছাই করে চামড়া কেনেন এবং ঠিকমতো মূল্য পরিশোধ করেন না। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এখনও তাদের কাছে কোটি টাকার মতো বকেয়া পায়। তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। কিন্তু সরকার কেবল ট্যানারি মালিকদের এই সুবিধা দিয়ে আসছে।
এদিকে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী ও নাটোর থেকে বড় ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে রাজারহাটে আসেন। ঈদের পরবর্তী সময়ে এখানে প্রায় ১০ হাজার ছোট-বড় ব্যবসায়ী চামড়া বেচাকেনায় অংশ নেন এবং প্রায় শত কোটি টাকার লেনদেন হয়। কিন্তু বর্তমানে বকেয়া আদায় না হওয়া, খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে অস্থিরতা থাকায় অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন। প্রথম হাটেই চামড়ার আসল দাম পাচ্ছেন না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এ কারণে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ছাগলের চামড়া ভৈরব নদে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।