খুলনা | সোমবার | ১৬ জুন ২০২৫ | ২ আষাঢ় ১৪৩২

খেলাপি ঋণে রেকর্ড, অঙ্ক ছাড়ালো ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি, ব্যাংক খাতে উদ্বেগ

খবর প্রতিবেদন |
১০:৫৮ পি.এম | ১৫ জুন ২০২৫


লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসায় আরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বা নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বেড়েছে ৭৪,৫৭০ কোটি টাকা। মার্চে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত শ্রেণিকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এর আগের প্রান্তিকে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বেড়েছে। হার বেড়েছে ৩.৯৩ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে। পাশাপাশি আগের সরকারের সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যেসব শীর্ষ গ্র“পের মন্দ ঋণ গোপন ছিল- সেগুলোর অনেকটাই এখন শ্রেণিকরণের আওতায় আসায়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গেছে। অর্থাৎ লুকানো খেলাপি ঋণের আসল চিত্র সামনে আসায় আরও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অনেকদিনের গোপন খেলাপি এখন প্রকাশ পাচ্ছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও পদ্মা এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোতে খেলাপির মাত্রা বেশি। তিনি মনে করেন, নিয়মমাফিক হিসাব করলে জুনে এ চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।
তবে তিনি এটিও বলেন, সব ব্যাংককে এক পাল­ায় মাপা ঠিক নয়। অনেক ব্যাংক এখনো ভালো অবস্থায় আছে। তাই পুরো ব্যাংক খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সা¤প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খেলাপি ঋণের কোনো তথ্য আমরা লুকিয়ে রাখবো না। সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আদায় জোরদারের মাধ্যমে কমানো হবে। নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয় সে জন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনার কথা জানান তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কয়েকটি গ্র“প ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছে। যাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। গত ৫ আগস্টের আগে ঋণ পরিশোধ না করেও বিভিন্ন উপায়ে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ ছিল। তবে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন সেই সুযোগ বন্ধ হওয়ায় এখন তারা খেলাপি। এরই মধ্যে এস আলম, বেক্সিমকোসহ শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।
দেড় দশকে বিশগুণ ঊর্ধ্বগতি : ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেখান থেকে তা প্রায় বিশগুণ বেড়ে ২০২৫ সালে এসে ৪ লাখ কোটির ঘরে পৌঁছেছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল তদারকি এবং শিথিল নীতির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গোপন খেলাপির মুখোশ উন্মোচন : বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এতদিন নানা পুনঃতফসিল ও নীতিগত সুবিধার মাধ্যমে অনেক খেলাপি ঋণকে নিয়মিত হিসেবে দেখানো হচ্ছিল। তবে বর্তমান সরকার পরিবর্তনের পর সেই সুবিধা স্থগিত হলে প্রকৃত চিত্র সামনে এসেছে।
আলোচনায় শীর্ষ গ্র“পগুলো : ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচারের। এর মধ্যে এস আলম গ্র“প, বেক্সিমকো, নাসা গ্র“পসহ বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানির নাম উঠে এসেছে, যাদের কেউ জেলে, কেউ দেশ ছেড়েছে।
ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ উলে­খযোগ্য হারে বেড়েছে। এস আলম গ্র“পের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলোতে ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাচ্ছে।
ব্যাংক খাতে আস্থাহীনতা : ব্যাংকাররা বলছেন, অল্প কয়েকজনকে বিশেষ সুবিধা দিতে গিয়ে গোটা ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়েছে। ফলে নতুন ঋণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন অর্থায়ন থেকে এবং আমানতকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট বাড়ছে।