খুলনা | শনিবার | ২৮ জুন ২০২৫ | ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

আর নয় পলাশী

অ্যাডভোকেট এম. মাফতুন আহমেদ |
১১:৩০ পি.এম | ২২ জুন ২০২৫


আজ ২৩ জুন। ১৭৫৭ সালের এই দিনটি পাক-ভারত উপমহাদেশের কোটি মুসলমানের ইতিহাসে রক্তাক্ত বেদনাবিধুর স্মৃতি বহুল একটি দিন। এ দিনে সংঘটিত হয়েছিল বেনিয়া বৃটিশ এবং তাদের বংশবদগণের বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক যুদ্ধ নাটক। এ নাটকীয় যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজদৌল্লার শুধু ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেনি। ঘটেছিল উপমহাদেশের আজাদীর জয় গানে উদ্ধুদ্ধ লাখো কোটি মানুষের। 
পলাশীর যুদ্ধই বাঙ্গালীর প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। প্রথম আজাদীর লড়াই। এই লড়াই ছিল বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে এবং এ দেশীয় দোসর ব্রাহ্মণ্যবাদীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী মুসলমানদের প্রথম সংগ্রাম। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, পৃথিবীর ইতিহাসে অক্ষয় আসন অধিকার করে রয়েছে ও থাকবে। তরুণ ও তেজস্বী নবাব সিরাজদৌল্লা যদি স্বাধীনচেতা না হতেন তা হলে তিনি অতবড় ঝুঁকি নিতেন না। তিনি রণাঙ্গনে আপোষ না করে সংগ্রামের পথ বেঁছে নেন। তাই উপমহাদেশের আজাদীর আফতাব জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অমনি ধরনের আর এক রাজনৈতিক সংকটের সময় লিখেছিলেন-
“কান্ডারী। তব সম্মুখে ওই
পলাশীর প্রান্তব,
বাঙ্গালীর খুনে লাল হল
যেথা ক্লাইতের খঞ্জরে। ওই গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়
ভারতের দিবাকর,
উদিকে  সে রবি আমাদেরই খুনে
রাঙ্গিয়া পুর্নবার”।
এ জন্য এ দিনটি সবার মানসপটে বিশদময় একটি দিন। নবাব আলীবর্দি খানের দৌহিত্র সিরাজ যখন বাংলার মসনদে আসীন হন সময়টা ছিল তার জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। সর্বত্র যড়ন্ত্রের ধুম্রজালে তিনি হয়ে পড়েছিলেন জিম্মি। তাই পলাশী প্রান্তরে তার জন্য বিপর্যয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। মুসলমানদের অধঃপতন এবং ধ্বংসের প্রতীকরূপে মোগল সম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী তাদের আমীর ওমরাহ প্রভৃতির মধ্যে ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্ব›দ্ব, ভোগ বিলাসে আচ্ছন্নতা এবং জনগণের মধ্যে বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে বদ্ধতা, নৈতিক তমুদ্দিনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের দরুন এই ষড়যন্ত্রকারীদের হাত প্রসারিত করেছিল। 
তরুণ নবাব সিরাজদৌল্লার চৌদ্দ মাস শাসনকাল অতিক্রম করতে হয়েছিল এক জটিল কুটিল চক্রান্তের মধ্য দিয়ে। একদিকে শওকাত জঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ঘষেটি বেগমের চক্রান্ত মোকাবেলা আহমদ শাহ অবদালীর আক্রমণ এবং প্রতিনিয়ত সৈন্য মোতায়েন, প্রভৃতি বড় ধরনের ব্যাপারে গভীর মনোযোগ দিতে হয়েছে। এর সাথে ছিল ছোট বড় নানাবিধ জটিল সমস্যা। বিশেষ করে নবাব দরবারের প্রধান প্রধান ব্যক্তিবর্গের ষড়যন্ত্র ও বিরোধিতা নবাবকে দিশেহারা করে তুলেছিল। ফলে নির্দিষ্ট কোন বিষয় মনোযোগ দিতে না পারলে ইংরেজরা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষে ঠিকই এগিয়ে চলেছিল। ইংরেজদের পক্ষে এই এ রকম আক্রমণ আসতে পারে নবাব আলীবর্দী খাঁ প্রথম থেকে আশঙ্কা করেছিলেন। 
নবাব আলীবর্দী খাঁ মূলত রাজন্যবর্গ উচ্চ পদস্থ রাজ কর্মচারীদের উপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন। রাজকর্মচারীদের অধিকাংশ ছিলেন হিন্দু। মুসলমানদের এই দুর্বলতার সুযোগে এই সব রাজকর্মচারীরা অর্থনৈতিক দিক থেকে ফায়দা লুটতে থাকে। তারা পর্যায়ক্রমে সংগঠিত হতে থাকে। এই সুযোগে বেনিয়া বৃটিশরা এদের সাথে গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকে। ফলে নবাব আলীবর্দী খানের উদার মানসিকতার দরুন যুবক সিরাজকে হতে হয়েছিল এই অকাল ষড়যন্ত্রের স্বীকার।
আর সেই ষড়যন্ত্র নতুন করে আবার শুরু হয়েছে। যারা সেদিন শহিদ সিরাজের বিরুদ্ধে এদেশীয় বশংবদরা ষড়যন্ত্র করেছিল তারাই আবার নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। স্বাধীন বাংলার মানুষ আর কোন পলাশীর পদধ্বনী শুনতে চায় না। 
লেখক : সম্পাদক আজাদবার্তা, কলামিষ্ট ও আইনজীবী।