খুলনা | বুধবার | ২৫ জুন ২০২৫ | ১১ আষাঢ় ১৪৩২

কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্যে

দায় স্বীকারের পরও দুই মাস অতিবাহিত হলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন

বিশেষ প্রতিনিধি |
০২:১৯ এ.এম | ২৫ জুন ২০২৫


কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নিয়োগ বাণিজ্যে অর্থ গ্রহণের দায় স্বীকার করার পরও দীর্ঘ দুই মাস অতিবাহিত হলেও কার্যত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি প্রশাসন। নানা অনিয়মের অভিযোগে অধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকসহ এলাকাবাসী যখন বহিষ্কারের দাবিতে সোচ্চার ঠিক তখনই তদন্ত চলাকালীন সময়ের মধ্যে ছুটি মঞ্জুর ও তদন্তে দীর্ঘসূত্রীতা আন্দোলনকারী শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্র- ছাত্রীদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে। 
এদিকে প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের আবারো ফেরার গুজবে উত্তপ্ত মাদ্রাসা ক্যাম্পাস।  দ্রুত সময়ের মধ্যে  দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের স্থায়ী বহিষ্কার না করলে ক্লাস বর্জনের পাশাপাশি কঠিন কর্মসূচির ইঙ্গিত দিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। 
জানা গেছে, ২৬ ফেব্র“য়ারি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও কর্মচারীবৃন্দ অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, নারী কেলেঙ্কারি, নিয়োগ বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা ও অসাদাচরণের অভিযোগে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি বরাবর লিখিত আবেদন করেন। 
আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬ এপ্রিল অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মানববন্ধন ও দুর্নীতির অভিযোগ সরেজমিনে তদন্তে আসেন, জাফর আউলিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসার সভাপতি ও খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা) এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহেরা নাজনীন ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ শাহাজান আলী। পরবর্তীতে ২৮ এপ্রিল সভাপতির কার্যালয়ে এডহক কমিটির একটি মিটিংয়ে অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারকে শোকজ, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ ও এসি ল্যান্ডকে আহবায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এ আলোকে ১২মে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পাইকগাছা, তদন্তকার্য সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করেন। অধ্যবধি দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের  বিরুদ্ধে কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে গত ১৯ জুন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে  শিক্ষক কর্মচারীদের অপর এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এর অনুমোদনক্রমে রেজিস্টার মোঃ আইয়ুব হোসেন স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে পাইকগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে সরেজমিন তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য বলা হয়েছে। 
সরেজমিন মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে গেলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জামিরুল ইসলাম ঘটনা সত্যতা স্বীকার করেছেন। আন্দোলনকারী শিক্ষক কর্মচারী এবং উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রী দুর্নীতিবাজ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তারা খুব প্রকাশ করেন। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বলেন, স্থায়ী বহিষ্কার না হলে সকল শিক্ষক কর্মচারী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন। অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জনের পাশাপাশি কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা ইঙ্গিত করেন। অভিভাবকরা বলছেন, দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর আবারও এমন কর্মসূচিতে গেলে ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ও হতাশায় রয়েছেন 
উলে­খ্য, অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদানের পর থেকে আব্দুস সাত্তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অসদাচরণ ও নারী কেলেঙ্কারির সাথে নিজেকে জড়িয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত হন। এরই ধারাবাহিকতায়  ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত মাদ্রাসার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের নামে ২৯ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি তৎকালীন সভাপতি ও এডিসি রাজস্ব খুলনা, মুকুল কুমার মৈত্র, অধ্যক্ষের দাখিলকৃত মাদ্রাসা উন্নয়নের নামে ৪০ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯০৯ টাকা ঋণ দেখিয়ে রেজুলেশন প্রস্তুত করলে সভাপতি উক্ত রেজুলেশন এর হিসাব  সংক্রান্ত অংশ কেটে দেন এবং আভ্যন্তরীণ অডিট প্রতিবেদন জমা প্রদানের নির্দেশ দেন। এছাড়া অধ্যক্ষ সরকার প্রদত্ত পিবি জিএসআই অনুদানের ৫ লক্ষ টাকা গভর্নিংবডি বা শিক্ষকদের কাউকে কিছু না জানিয়েই নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খরচের ভাউচার জমা না দেওযয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ভাউচার জমা না দেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা প্রকাশ করেছেন তার চতুর্থ তাগিদাপত্রেও অত্র প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। জানা গেছে, অত্র মাদ্রাসায় বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কাছ থেকে এমপিওভুক্তি, বিএড স্কেল, উচ্চতর স্কেল ও বেতন করানোর নামে বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে হাজার হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহণ করেছেন অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার। এনটিআরসিএ থেকে নিয়োগ প্রাপ্ত প্রভাষক ও শিক্ষকদের কাছ থেকে সভাপতি, রেজুলেশন বাবদ এবং বেতন করানোর নামে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও কর্তা ব্যক্তিদের দেওয়ার কথা বলে হাজার হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। এমনকি মাদ্রাসা ক্যাম্পাসের আয়তন বৃদ্ধির জন্য স্বল্পমূল্যে জমি ক্রয়ের সময় দাতাদের ভুল বুঝিয়ে সাড়ে চার শতাংশ জমি নিজের নামে লেখার অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে জমিদাতারা আন্দোলনের হুমকি দিলে মাদ্রাসার জমি এক সপ্তাহের মধ্যে মাদ্রাসায় ফেরত দিবেন মর্মে লিখিত শর্তে স্বাক্ষর করেও অদ্যবদি তা ফেরত দেননি।  অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের সাথে মাদ্রাসার আয়ার গোপন প্রনয় রয়েছে। এ ব্যাপারে  শিক্ষক- কর্মচারী এর মধ্যে মোঃ মুজিবুর রহমান, এম এম জমিরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আলী হুসাইন, মোঃ শরিফুল ইসলাম, ফারহানা জাহান, নাজনীন সুলতানা, আব্দুল বাসেত, মোঃ ইউসুফ আলী, মোঃ হাসান আলী, মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, কাকলি টিকাদার, হোসনেয়ারা খাতুন, শিউলি রানী, সুরাইয়া খাতুন, মোঃ সরোয়ার খান, আনোয়ার সাদাত, মেহেদী হাসান, মোঃ মারুফ বিল্লাহ, এস কে মিজানুর ও শেখ মাসুদুজ্জামান  স্বাক্ষরকৃত  অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ এর অফিস কক্ষে রক্ষিত শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে গেলে  অধ্যক্ষ ও আয়ার আপত্তিকর অবস্থানের কারণে শিক্ষকদেরই বিভিন্ন সময় লজ্জায় পড়তে হয়েছে। উলে­খ্য অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তারের নানা অনিযয়, দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি ,জমি আত্মসাৎ ও মাদ্রাসা ক্যাম্পাসে অবৈধ ঝাড়ফুঁক ব্যবসা পরিচালনার প্রতিবাদে ২৩ ফেব্র“য়ারি জমি দানকারীর পরিবার পরিজন ও স্থানীয় এলাকাবাসী মানববন্ধন করেন। ইতোপূর্বে অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগে কপিলমুনি ইউনিয়ন পরিষদের সালিশি বৈঠকে তৎকালীন সময়ে আর্থিক জরিমানা ও তিরস্কারের ঘটনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে আঃ সাত্তার অর্থ গ্রহণের বিষয়টি স্বীকার করলেও অন্যান্য বিষয় ভিন্নমত পোষন করেন। 
কপিলমুনি জাফর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এল এ খুলনা নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ মুঠো ফোনে জানান, তদন্ত চলমান। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।