খুলনা | শনিবার | ২৮ জুন ২০২৫ | ১৪ আষাঢ় ১৪৩২

মানুষকে হত্যার ভয়াবহ বর্ণনা দিলো ইসরায়েলি সেনারা

গাজায় ইসরায়েলের মৃত্যুফাঁদ, ত্রাণ নিতে গিয়ে এক মাসে নিহত ৫৪৯

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৮ এ.এম | ২৮ জুন ২০২৫


ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় গাজা উপত্যকায় অন্তত ৭২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের অনেকেই খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
শুক্রবার কুয়েত ফিল্ড হাসপাতাল সূত্রে আল-জাজিরা জানিয়েছে, রাফাহের উত্তরে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর একটি ত্রাণকেন্দ্রের পাশে ইসরায়েলি গুলিতে অন্তত ছয়জন প্রাণ হারান।
তবে বিতর্তিক এ সংস্থা শুরু থেকেই ব্যর্থ হয়। তাদের এখানে যখনই মানুষ ত্রাণ নিতে গেছে, তখনই হত্যার শিকার হয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, গত এক মাসে কেবল ত্রাণ সংগ্রহের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৫৪৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ৬৬ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনা ঘটেছে জিএইচএফের বিতর্কিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশেই।
চলতি বছরের ফেব্র“য়ারি থেকে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান ‘গাজা মানবিক ফাউন্ডেশনের’ মাধ্যমে গাজার সাধারণ মানুষকে ত্রাণ দেওয়া শুরু করে দখলদার ইসরায়েল। এতে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র।
‘সাহায্যের নামে হত্যাযজ্ঞ’ : বহুজাতিক চিকিৎসাসেবী সংগঠন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত জিএইচএফ প্রকল্পটি বাস্তবে ‘মানবিক সাহায্যের নামে গণহত্যা’। তারা এই পরিকল্পনাকে ‘সাহায্যের ছদ্মবেশে নৃশংসতা’ হিসেবে বর্ণনা করে অবিলম্বে বন্ধের দাবি জানিয়েছে।
এমএসএফ আরও বলেছে, এই কাঠামোটি ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের অপমান করছে, যেখানে মানুষকে বেছে নিতে বলা হচ্ছে, ক্ষুধায় মরবে, না কি গুলি খেয়ে?
বাড়ছে আন্তর্জাতিক সমালোচনা : জিএইচএফ নামের এই বিতর্কিত সংগঠনটি বর্তমানে গাজায় মানবিক সহায়তার প্রধান সরবরাহকারী হলেও জাতিসংঘসহ বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা তাদের সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সমালোচকদের অভিযোগ, সংগঠনটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়াটে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় কাজ করছে। ফলে, ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষই প্রতিদিন গুলির মুখে পড়ছেন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ হিসাবে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এ পর্যন্ত ৫৬ হাজার ২৫৯ জন নিহত এবং ১ লাখ ৩২ হাজার ৪৫৮ জন আহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও কয়েক হাজার মানুষ, যাদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা নেই বলেই ধরে নেওয়া হয়। 
এসব মানুষকে কতটা নির্মম ও নির্দয় ও কোনো কারণ ছাড়া হত্যা করা হয়েছে সেগুলোর ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা। তারা ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজকে জানিয়েছেন, অকারণেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। যারা ত্রাণ নিতে এসেছিলেন তাদের কেউই ইসরায়েলি সেনাদের জন্য ঝুঁকির কারণ ছিলেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেনা বলেছেন, “এটি হলো হত্যাযজ্ঞের মাঠ। আমি যেখানে মোতায়েন ছিলাম, সেখানে প্রতিদিন অন্তত এক থেকে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে। গাজার এসব মানুষকে শত্র“বাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তাদের সরাতে ভিড় ব্যবস্থাপনার কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়নি, কোনো কাঁদানে গ্যাসও ব্যবহার করা হয়নি। সরাসরি গুলি করা হয়েছে। ভারী মেশিন গান, গ্রেনেড লঞ্চার, কামান থেকে গোলা ছোড়া হয়েছে।” তিনি আরও বলেছেন, “যখন আমরা গুলি বন্ধ করতাম, তখন মানুষ বুঝত এখন তারা ত্রাণ কেন্দ্রের দিকে আগাতে পারবে। তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল গুলি।”
তিনি বলেন, “ভোরের দিকে যদি কেউ ত্রাণ কেন্দ্রের লাইনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতো, যা আমাদের অবস্থান থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরে, আবার কিছু ক্ষেত্রে আমরা কাছ থেকে গুলি করতাম। কিন্তু আমাদের সেনাদের জন্য তারা কেউই ঝুঁকির কারণ ছিল না। আমি এখন পর্যন্ত শুনিনি যারা ত্রাণ নিতে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ গুলি ছুড়েছে। সেখানে কোনো শত্র“ ছিল না। কোনো অস্ত্র ছিল না।”
অপর এক সেনা বলেছেন, “ক্ষুধার্ত মানুষকে দূরে রাখতে কামান থেকে গোলা ছোড়া কোনো পেশাদারিত্ব নয়, মানবিক কাজও নয়। আমি জানি হামাসের কিছু যোদ্ধাও (ত্রাণ কেন্দ্রের কাছে) সেখানে ছিল। কিন্তু সেখানে এমন মানুষ ছিলেন যারা শুধুমাত্র ত্রাণই নিতে এসেছিলেন।”
তিনি বলেছেন, “এটি এমন জায়গায় পরিণত হয়েছে, যেখানে নিজস্ব আইন চলে। মানুষের মৃত্যু সেখানে কিছুই না। এমনকি কোনো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হিসেবেও এসব হত্যাকাণ্ডকে উলে­খ করা হয় না।”
এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে এসব ঘটনা নিয়ে যোগাযোগ করলে তারা এগুলো অস্বীকার করেনি আবার স্বীকারও করেনি।
তবে ইসরায়েলি সেনাদের স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা মিলিটারি এড. জেনারেল অফিস জানিয়েছে, ত্রাণ কেন্দ্রে আসা নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনারা যে যুদ্ধাপরাধ করেছে সেগুলোর তদন্ত তারা করবে। 
হারেৎজ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলি সেনাদের অভিযোগ, সেনা কমান্ডাররা সরাসরি ভিড়ের দিকে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে ওই এলাকাগুলো খালি করা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) যেসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন দাবি করেছিল, সেগুলোর আইনি ব্যাখ্যা সামরিক আইনজীবীরা একান্ত বৈঠকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ত্রাণ বিতরণে প্রবেশাধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্তি চলছে। সেনাবাহিনী এক সময় জিএইচএফ কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার পথগুলোতে সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছিল। কিন্তু খাদ্য পেতে হলে স্থানীয়দের মধ্যরাতের আগেই বের হতে হয়, কারণ সকালেই হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে পড়েন কেন্দ্রে। 
সূত্র: আল-জাজিরা ও হারেৎজ।