খুলনা | রবিবার | ২৯ জুন ২০২৫ | ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

মহাসমাবেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনের ১৬ দফা ঘোষণাপত্র

সংসদের প্রস্তাবিত উভয়কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে

খবর প্রতিবেদন |
০১:১৭ এ.এম | ২৯ জুন ২০২৫


আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর পাশাপাশি দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দল নিয়ে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চলছে জানিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাইর পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেছেন, এই ঐক্য গড়তে পারলে আগামী দিনে আমাদের হাতেই আসবে রাষ্ট্রক্ষমতা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আয়োজিত মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
চরমোনাইর পীর বলেন, ‘আমরা বারবার রক্ত দিয়েছি, কিন্তু সফলতা পাই নাই। কারণ, আমরা প্রতিবারই নেতা ও নীতি বাছাই করতে ভুল করেছি। আমরা ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছি। কিন্তু ইসলামকে এখনো ক্ষমতায় নিতে পারি নাই। এবার ইসলামপন্থীদের ঐক্যের ব্যাপারে গণপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।’
ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ‘আমি শুরু থেকেই ইসলামপন্থী সকল ভোট একবাক্সে আনার কথা বলে আসছি। আগামী নির্বাচনে শুধু ইসলামী দলই নয়, বরং দেশপ্রেমিক আরও অনেক রাজনৈতিক দলও একবাক্স নীতিতে আসতে পারে, ইনশাআল­াহ। যদি আমরা একত্রে নির্বাচন করতে পারি, যদি কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরাই হবে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই আসবে ইনশাআল­াহ।’
চরমোনাই পীর বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে। যে যত শতাংশ ভোট পাবে তাদের তত শতাংশ প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এটা এখন জনগণের দাবি, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের দাবি।’ এ সময় তিনি বিএনপিকেও পিআর সিস্টেমে নির্বাচনে আসা উচিত বলে মত দেন।
রেজাউল করীম বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কার নিয়ে এখন দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলছে। আমরা দেখছি মৌলিক সংস্কারে কেউ কেউ আপত্তি করছেন। এটা দ্বিমুখিতা। সংস্কার না হলে গণভোটের আয়োজন করতে হবে।’
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘পতিত ফ্যাসিস্ট জুলুমের রাষ্ট্র তৈরি করেছিল। তারা লাখ লাখ মানুষ খুন, গুম করেছে। তাদের কোনো ক্ষমা নাই। যারা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত ছিল তাদের বিচার করতে হবে। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত সকলকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
ইসলামী আন্দোলনের আমির বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ কোনো দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, চাঁদাবাজকে সরকারে চায় না। চাঁদাবাজি, খুন করার জন্য, দখলের জন্য চব্বিশে এসে জীবন দেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ খুন হবে না, গুম হবে না। ইসলামী দল ক্ষমতায় গেলে কাউকে চাঁদা দিতে হবে না, বাংলাদেশ মসজিদ থাকবে, মন্দির থাকবে।’
মুফতি রেজাউল করীম বলেন, ‘যারা মোল­াদের দাড়ি টুপি নিয়ে গালি দেবে তাদের ক্ষমতায় আমরা যেতে দেব না। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের গোলামী করার জন্য জীবন দেয় নাই, রক্ত দেয় নাই। বাংলাদেশের মানুষ জীবন দিতে পারে কিন্তু কারও গোলামী করতে পারে না। মঞ্চে যারা আছেন তারা যদি একসঙ্গে থাকেন, কথা রাখেন, তবে আগামীতে ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় যাবে।’
ইসলামী আন্দোলনের ১৬ দফা দাবি : রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মহাসমাবেশ থেকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে ১৬ দফা দাবি জানিয়েছে। একটি ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়। শনিবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংগঠনটির মহাসমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান। সংস্কার, বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে এবং দেশ ও ইসলাম বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের প্রতিবাদে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।
যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠকালে বলেন, সংস্কার নিয়ে দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলমান রয়েছে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ঘোষণা করছি যে, সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সাথে ‘আল­াহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ এ বিষয়টি অবশ্যই পুনঃস্থাপন করতে হবে। কারণ বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌমত্বের জন্য ইসলাম হলো রক্ষাকবচ। তার প্রতিফলন সংবিধানের মূলনীতিতে থাকতে হবে।
সংসদের প্রস্তাবিত উভয়কক্ষে সংখ্যানুপাতিক পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দিতে হবে।
জুলাই’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা বাস্তবায়নে বৈষম্যহীন শোষণ নিপীড়ন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জাতীয় ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আগামী জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে।
আগামী দিনে বাংলাদেশে যাতে কোনো নির্বাচিত স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও সন্ত্রাসী শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংস করতে না পারে এবং একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করতে না পারে সে জন্য প্রয়োজনী মৌলিক রাষ্ট্রসংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অপরিহার্য। সেটা নিশ্চিত করার জন্য জনপ্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। পতিত ফ্যাসিবাদের সহযোগী যারা এখনো জনপ্রশাসনে কাজ করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুত অপসারণ করতে হবে। না হলে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেই যাবে।
পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এবং বিদেশে পলাতক অপরাধীদের আটক করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে।
দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সক্রিয়, কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
দেশে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও খুনখারাবি রোধে প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও অবিচল হতে হবে।
ভারতের সাথে কৃত সকল চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে এবং সকল দেশবিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সকল পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আগামীতেও জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে সকল স্থানীয় নির্বাচনের বিধান প্রণয়ন করতে হবে।
চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি ও সন্ত্রাসীদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বে দেশে অবশ্যই একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সকল দলের জন্য সমতল পরিবেশ এবং সমান সুযোগ তৈরি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক পক্ষ বা ভিন্ন কোনো দেশের চাপে অতীতের মতো যেন-তেন একটি নির্বাচনের জন্যে তফসিল ঘোষণা করা হলে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া হবে না।
ঘুষ, দুর্নীতিসহ সকল প্রকার নাগরিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক কারণে হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করতে হবে। হয়রানিমূলক সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। দেশের কোথাও কোনো রকম ‘মব’ সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া যাবে না। ‘মব’ সৃষ্টিকারীদের দমনে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী যেকোনো কার্যক্রমে দ্রুততম সময়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে গণবিক্ষোভ পুঞ্জীভূত না হয়।
দেশবিরোধী ও ইসলাম বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলায় সাম্রাজ্যবাদ, স¤প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক ও ইসলামী শক্তির ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা, জনগণের জান-মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান, সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি সুরক্ষা, সর্বত্র শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং কাক্সিক্ষত উন্নতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে ইসলামের সুমহান আলোকিত আদর্শের অনুশীলন করতে হবে।