খুলনা | রবিবার | ২৯ জুন ২০২৫ | ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

কেয়ার অব কপোতাক্ষ!

পারভেজ মোহাম্মদ |
০১:৩৪ এ.এম | ২৯ জুন ২০২৫


ভরা যৌবনে কপোতাক্ষ তার ভিটা-মাটি খেয়েছে। মাটি আঁকড়ে থাকতে না পারলেও সেই কপোতাক্ষই আজ তাদের ঠিকানা। মাটির স্পর্শ ছাড়াই ছোট্ট সুখের নীড়। যে নীড়ে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলে অবলীলায়। গর্বের রাজপ্রাসাদে সূর্যের  আলোর অবাধ যাতায়াতে বাধা থাকলেও এখানে ভোরের ঠিকরে পড়া আলোয় ঘুম ভাঙ্গে এক প্রেমিক যুগলের। ইতোমধ্যে অকৃত্রিম ভালোবাসার বয়সসীমা হাফ সেঁঞ্চুরি ছাড়িয়েছে। যেখানে নিত্যদিন চলে হানিমুন। প্রেমিক যুগলের  ভালোবাসায় ঠাঁই মেলে সুন্দর পৃথিবীর নতুন নতুন ঠিকানা। অন্যদের থেকে পার্থক্য শুধু, জায়গা পরিবর্তন হলেও আবাসন কিন্তু একটাই। তাদের স্বপ্নের সোনালী নীড়। কুলু- কুলু ধ্বনি, ছোট ছোট ঢেউ। তেল গ্যাস হীন বাহন। যত  দূরেই যায়,  ঠিকানা একটাই। কেয়ার অব কপোতাক্ষ। 
পাইকগাছা উপজেলার ডিঙি নৌকায় বাধা সুখের নীড়ে বসবাস সুখেন-নমিতার কথা বলছি। এই বিশাল ধরিত্রীর কোনখানে  ঠাঁই হয়নি। সব হারিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাথে নিয়ে নদীতে ভাসমান জীবন যাপন 
সুখেন বিশ্বাসের। সেঞ্চুরির পথে হাঁটছে সুখেন বিশ্বাস। সহধর্মিণীও একই পথে হাঁটছেন একটু দূরত্বে। অস্থিঃ চর্মসার এই মানুষ দু’টির বেঁচে থাকার  একমাত্র সম্বল ডিঙি নৌকা। যে নৌকায় বসবাস, সেই নৌকাতেই ক্ষুধা মেটাবার একমাত্র অবলম্বন। সৃষ্টিকর্তাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। কপোতাক্ষের নোনা জলেই খাদ্য আহরনের একমাত্র পথ। প্রতিনিয়ত  ক্ষুধার  কামড়ে ক্ষতবিক্ষত  সুখেন-নমিতার শরীর। তবুও কোন অভিযোগ নেই। নদের মাঝে ভিটামাটি, সহায় সম্বল হারিয়ে জীবন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে সেই নদেই ডিঙি নৌকায় ভাসমান জীবন যাপন করে চলেছেন সুখেন বিশ্বাস। তার দেখা মেলা ভার। জীবন যুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে কপোতাক্ষের একূল থেকে ওকূলে, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। জীবিকা নির্বাহে  নদীতে মাছ ধরে চলছে দিন। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে যে মাছ পান সেটা বিক্রি করে কোন ভাবে জীবন যাপন করে চলেছেন। বয়সের ভারে মাথা নুঁয়ে ঠেকেছে দুই হাঁটুতে। শরীরটাও আগের মত কথা শোনেনা। কোন দিন আধাপেটা, কোন কোন দিন  উননে  আগুন জ্বলে না। বেশির ভাগ সময় শুকনা খাবার, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটই ভরসা। বৈরী আবহাওয়া, ঝড়-ঝঞ্ঝা, তপ্ত রোদ তাদের শিষ্যত্ব বরণ করেছে। সুখেনের সর্বক্ষণ সাহস, অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন সহধর্মিণী নমিতা। তাদের অপূর্ব ভাসমান প্রেম, গভীর ভালোবাসা। একটু অসুস্থতায় একে অন্যের মধ্যে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার যেন শেষ নেই। পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া মালোপাড়ায় একদিন তাদের সব ছিল। ঘরবাড়ি, বাগ-বাগিচা, গরু, জায়গা জমি। নদী সব কেড়ে নিয়েছে। এটা আমার নিয়তি। সৃষ্টিকর্তার কাছে একমাত্র প্রার্থনা শাখা সিঁদুর নিয়ে যেন মরতে পারি। কথা গুলো নোনা জলের সাহসী যোদ্ধা  নমিতার। তাদের এক মেয়ে থাকে মালোপাড়ায়। মাঝে মধ্যে প্রাণের টানে ছুটে যান সেখানে। এমনই একটা সময়ে মালোপাড়া ঘাটের ধারে দেখা মেলে সুখের-নমিতা দম্পতির। এখন আর নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। যেতে হবে বহুদূর। যদি বেঁচে থাকি কথা হবে অন্যদিন, খুঁটিতে বাঁধা নৌকার দড়ি খুলতে খুলতে বলছিল সুখেন বিশ্বাস। আবারো দড়ির গিটের সাথে জীবনের গিট খুলতে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে সুখেনের বেরিয়ে পড়া। নদীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কপোতাক্ষের ঢেউয়ে ভেসে চলে সুখেনের ভালোবাসা। নোনা জল আর নোনা ঘামের গুমোট গন্ধে সুখেনের ভালোবাসার মানুষ মেলা ভার। স্বার্থের এই দুনিয়ায় তাদের আপন বলে কেউ নেই। তবে কি সুখেন দম্পতি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসেও জুটবে না মাথা গোঁজার ঠাঁই। নানা জটিলতা, নানা সমীকরণে  মুখ থুবড়ে পড়ে সুখেন দম্পতির স্বপ্ন। ভাসমান ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকায় বাঁধা সোনালী নীড় যেন ভালোবাসার স্বর্গ।  জীবনের সন্ধিক্ষণে এসে শরীর আর সায় দেয় না। বয়সের ভারে নুঁয়ে পড়া সুখেনের নদীতে মাছ ধরাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের মনের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেছে। হয়তো সুখেন-নমিতা  দম্পতির চিতার শেষ যবানিকাও হবে এই কপোতাক্ষে। সভ্য সমাজে সুখেনের ভাসমান নীড়েই যদি হয় শেষ সংলাপ তবে কি উত্তর আছে সমাজপতিদের। সুখেন-নমিতা দম্পতির একটু আত্ম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে প্রয়োজন মাথা গোঁজার ঠাঁই। চিতায় ওঠার আগেই ঠিকানা থেকে যেন মুছে ফেলা যায়, কেয়ার অব কপোতাক্ষ। তবেই ফিরবে স্বস্তি, মানুষ হবে সৃষ্টির সেরা।