খুলনা | সোমবার | ৩০ জুন ২০২৫ | ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচি : ধসের মুখে রাজস্ব ব্যবস্থা, কঠোর সরকার

খবর প্রতিবেদন |
০২:০৮ এ.এম | ৩০ জুন ২০২৫


আজ সোমবার (৩০ জুন) ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের শেষ দিন। গোটা জনু মাস জুড়ে চলছে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাতার আন্দোলন। বিক্ষোভ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে চলা এই আন্দোলন এখন সারাদেশে চলছে কমপি¬ট শাটডাউন কর্মসূচি (কর্মবিরতি)। ফলে অর্থবছরের শেষ মাসে এই আন্দোলন রাজস্ব আদায়সহ অর্থনীতির চাকা থমকে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে নেমে এসেছে মন্দা। সংস্কার নিয়ে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এখন জাতির গলার কাটা হিসেবে দেখ দিয়েছে। সরকারের নীতি নির্ধারনী এবং অর্থনীতির সংস্কার কমিটি মতে এই সংস্কার করতে বাধা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও বিগত সরকারের আমলে গড়ে ওঠা এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। যারা নেপথ্যে থেকে এই আন্দোলনে সহযোগিতা করছে। সরকার এই আন্দোলনকে অনাকাক্সিক্ষত মনে করে এবং কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার এনবিআরের সেবা ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করেছে। এনবিআর সংস্কারে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার। 
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে বিবেচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন কার্যত অচল। রোববার দ্বিতীয় দিনে চলে দেশব্যাপী কমপি¬ট শাটডাউন কর্মসূচি।
এনবিআরের এই অস্থিরতার মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানী রপ্তানিসহ সর্ব ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনবিআরের আন্দোলন প্রত্যাহার : এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলমান ‘শাটডাউনসহ’ সব ধরনের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ৯টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দেওয়া হয়।
আন্দোলনকারী সংগঠন ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এবং দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে আলোচনার ফলেই এ সিদ্ধান্ত এসেছে বলে জানা গেছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। এ সময় ব্যবসায়ীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর এবং এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি মির্জা আশিক রানা। 
গত শনিবার থেকে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘সম্পূর্ণ শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন শুরু করলে দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে চরম অচলাবস্থা দেখা দেয়। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউজ, বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া, বুড়িমারীসহ সব স্থলবন্দরে শুল্ক আদায় কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পণ্য খালাস স্থবির হয়ে পড়ে, যা রাজস্ব ঘাটতির পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।  
তীব্র এই অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দ্রুত সমাধানের আহŸান জানানো হয়। সরকারের সঙ্গে একাধিক দফায় আলোচনার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে আন্দোলন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লি¬ষ্ট নেতারা।
আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণার পর ব্যবসায়ী মহলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরে এসেছে। সংশ্লি¬ষ্টরা আশা করছেন, আজ (সোমবার) থেকেই বন্দর ও কাস্টমস কার্যক্রম পুরোদমে চালু হবে এবং বাণিজ্যে যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার, পদোন্নতি, নিরপেক্ষতা ও মর্যাদা সংরক্ষণের দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন করে আসছিল।
ছয় শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু : এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ছয় শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আকতারুল ইসলাম।  
আকতারুল ইসলাম জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কিছু অসাধু সদস্য ও কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে কর দাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে তাদের করের পরিমাণ কমিয়ে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে দুদকের কাছে।
তিনি বলেন, রাজস্ব কর্মকর্তাদের এমন দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে কর ফাঁকি দেওয়ার মিথ্যা মামলা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি করেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। 
আকতারুল ইসলাম বলেন, অনেক করদাতা আগাম কর দেন। আবার কেউ কেউ বেশি কর দেন। নিয়ম হচ্ছে এই কর হিসাব-নিকাশ করার পর বেশি দেওয়া হলে তা ওই করদাতাকে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বিশে¬ষণ আর সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ থেকে জানা যায়-করের বাড়তি টাকা ফেরত পেতে আরও অন্তত অর্ধেক টাকা ঘুষ বা উপহারে খরচ হয়। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তারা করের টাকা ফেরত দিতে গিয়ে নিজেরাও কামিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা।
একইভাবে, বিগত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চাকুরিকালীন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক, ভ্যাট ও কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে ও নিজে লাভবান হয়ে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে দুর্নীত, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন অনেকে। এমন অভিযোগে এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম,  ঢাকা কর অঞ্চল-৮ এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা, বিসিএস কর একাডেমির যুগ্ম-কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, ঢাকা কর অঞ্চল ১৬ এর উপ-কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা,  নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ও মূল্য সংযোজন কর বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান তারেক রিকাবদার, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুন্ডুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
এর আগে রোববার এনবিআরের সংকট নিরসনে এক বিবৃতি জানানো হয়, এনবিআর চলমান অচলাবস্থা নিরসনে অনতি বিলম্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাওয়া অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে কঠোর বার্তা দিয়েছে সরকার।
এনবিআরের সেবা ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা : এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মধ্যে সংস্থাটির সেবা ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রোববার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অতি জরুরি আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সকল কাস্টমস হাউস, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনসমূহের সকল শ্রেণির চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ 
এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টানা দ্বিতীয় দিনের মতো রোববার ‘কমপি¬ট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেন। এতে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে।  
এর আগে মে মাসে এনবিআরকে দু’টি ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দ’টি স্বতন্ত্র বিভাগ করার অধ্যাদেশ জারি হলে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। পরে সরকার আলোচনার আশ্বাস দিলে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়। তবে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আমাদের বাজেট ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। সংস্কারের বিরোধিতা ছাড়াও চলতি অর্থবছরের শেষ দুই মাসে তারা রাজস্ব আদায় মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। আন্দোলনের নামে এই কর্মকাণ্ড পরিকল্পিত, দুরভিসন্ধিমূলক এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি।’
সরকার দাবি করেছে, এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না করে তারা অনমনীয় অবস্থান নিচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করছে।
বিবৃতিতে সরকার জানিয়েছে, ‘অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।’
এনবিআর সংস্কারে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
রোববার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেন। তবে কমিটিতে কারা আছেন এবং কমিটির কার্য পরিধি কী হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, এনবিআর কীভাবে সংস্কার করা যায় সে বিষয়ে কমিটি আলাপ-আলোচনা করবে। তারা সবার কথা শুনবে।
৫ সদস্যের কমিটিতে কারা কারা আছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কমিটিতে কারা আছেন তাদের নাম আমি এখন বলবো না।
এনবিআরর ৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক, যারা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ওটা আমার কনসার্ন ডিপার্টমেন্ট না।
রোববার পৌনে ছয়টার দিকে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থ উপদেষ্টা। সন্ধ্যা ৭টার দিকে বৈঠক শেষ হয়।।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আইসিসিবি'র সহ-সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, মেট্রো পলিটন চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, এমসিসিআইর সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রæপের সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতির তাসকিন আহমেদ প্রমুখ। বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন।
ধসের মুখে রাজস্ব ব্যবস্থা : এনবিকআরের এই ‘অচলাবস্থা’ এখন আর কেবল এনবিআরের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নয়, দেশের সামগ্রিক রাজস্ব আহরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা ও বিনিয়োগ পরিবেশ সবই হুমকির মুখে। 
চেয়ারম্যান অপসারণসহ বিস্তৃত প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিতে কাস্টমস ও শুল্ক কর্মকর্তাদের ডাকা ‘কমপি¬ট শাটডাউন’ কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেও দেশের প্রধান প্রধান বন্দরগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে আখাউড়া, বেনাপোল, ভোমরা, বুড়িমারী ও হিলিসহ সব কাস্টমস হাউজেই কার্যক্রম বন্ধ থাকায় থমকে গেছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। এতে পণ্যজট, শিপমেন্ট বিলম্ব, এলসি নিষ্পত্তি বিঘœ এবং রাজস্ব আয় স্থগিতসহ নানাবিধ সংকট একযোগে ঘনীভূত হচ্ছে।
বিশে¬ষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ অচলাবস্থার ফলে দেশের অর্থনীতির প্রধান চক্র-রপ্তানি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। দৈনিক গড় হিসাবে বন্দরে প্রায় ৬০০-৮০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। সেই হিসাবে মাত্র দুই দিনে ক্ষতির পরিমাণ ১৫০০ কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থলবন্দরে স্থবিরতা : বেনাপোলে ৮০০ ট্রাক, আখাউড়ায় ১১ কোটি টাকার রফতানি আটকে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে বিল অব এক্সপোর্ট ও বিল অব এন্ট্রি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকায় অন্তত ১১ কোটি টাকার রফতানি কার্যক্রম থমকে গেছে। বেনাপোল স্থলবন্দরে, ভারতের পেট্রাপোল সীমান্তে আটকে আছে ৮০০-এর বেশি পণ্যবোঝাই ট্রাক। কাস্টমস শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় পণ্য খালাস, পরীক্ষা বা ছাড়ের কোনও কার্যক্রমই সম্ভব হচ্ছে না।
ভোমরা বন্দরে প্রতিদিন এক কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হলেও দুই দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকায় ভারত-বাংলাদেশ উভয়মুখী ট্রাক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ।
বুড়িমারী ও হিলি বন্দরে একই চিত্র। শত শত ট্রাক বন্দরে অবস্থান করলেও কোনও খালাস হয়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির, প্রতিদিন ক্ষতি ২৫০০ কোটি টাকা : এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশের সব বন্দর, কাস্টম হাউজ, ভ্যাট কমিশনারেট এবং কর অঞ্চলগুলোতে তাদের কার্যক্রম বন্ধ রাখায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের অভ্যন্তরে আটকে আছে অন্তত ৩৬৮০টি রফতানি কনটেইনার, যার বেশিরভাগে আছে তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্য।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স বলছে, এভাবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি রফতানি ও আমদানির সঙ্গে যুক্ত।
শিল্প উৎপাদনে ধস, শ্রমিক বেতন অনিশ্চয়তা : রাজস্ব সনদ, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, ইউটিলিটি অনুমোদন, পণ্য ছাড়পত্র, এসব কার্যক্রম না হওয়ায় শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে পোশাক, চামড়া, সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন রপ্তানিমুখী খাতে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানান, এভাবে চললে প্রতি সপ্তাহেই বহু কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হবে। তিনি বলেন, ‘পোশাক খাতে প্রতিদিন ২৫০০ থেকে ২৬০০ কোটি টাকার কার্যক্রম থেমে যাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা শিপমেন্ট বিলম্বিত হওয়ায় চুক্তি বাতিলের হুমকি দিচ্ছেন। হারানো বাজার ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।’ 
মেট্রোপলিটন চেম্বার সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, ‘কাঁচামাল না এলে শিল্প ধসে পড়বে। বৈদেশিক ক্রেতারা অনেক ক্ষেত্রে চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে গুরুতর ধাক্কা লাগছে।
বাজারে সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির হুমকি : কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি আটকে থাকায় নিত্যপণ্য, ওষুধ ও শিল্পপণ্যের সরবরাহ চেইন হুমকির মুখে পড়েছে। বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দিলে মূল্যবৃদ্ধির নতুন ঢেউ সৃষ্টি হতে পারে, যা সাধারণ ভোক্তাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি বিপন্ন, বিদেশি বিনিয়োগে সংকট : আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধাবস্থার বাইরেও কোনও দেশে কাস্টমস কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকা নজিরবিহীন। এটি বাংলাদেশের ট্রেড র‌্যাংকিং ও আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে নেতিবাচক প্রতিফলন ফেলবে।’
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রশাসনের স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।