খুলনা | বৃহস্পতিবার | ১৭ জুলাই ২০২৫ | ২ শ্রাবণ ১৪৩২

এনসিপির সমাবেশ ঘিরে নিষিদ্ধ ঘোষিত আ’লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের তান্ডব : ডিসির বাসভবনে হামলা, ইউএনও গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর, পুলিশের গাড়িতে আগুন

গোপালগঞ্জে রণক্ষেত্র : নিহত ৪, আহত অর্ধশত

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি |
০১:৫৪ এ.এম | ১৭ জুলাই ২০২৫


জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জে বুধবার দিনব্যাপী হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ, নির্বাহী অফিসারের গাড়িতে ভাঙচুর ও পুলিশের গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় জেলার বিভিন্ন স্থান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে চারজন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেন জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ জিবিতেশ বিশ্বাস।
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ ঘটনা জানতে গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানকে বারবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
অন্যদিকে আহত হয়েছেন বেশ কিছু পুলিশ সদস্য ও গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি চালক। হামলাকারীরা পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয় এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িতে চড়াও হয়। তবে হামলার সময় রকিবুল হাসানের সাথে একজন ম্যাজিস্ট্রেটও ছিলেন। কিন্তু তিনি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কোনও শারীরিক ক্ষতি হয়নি বলে জানা গেছে।
এনসিপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকজন এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। পুলিশের সামনেই এই হামলা চালানো হলেও কোনও বাধা দেয়নি।
এদিকে গোপালগঞ্জে বিপুল সংখ্যক সেনা, র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। নিষিদ্ধ আ’লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলায় গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে ব্যাপক হামলা করা হয়। বাদ যায়নি জেলা প্রশাসকের বাসভবনও। হামলার তীব্রতা এমনই ছিল যে, এনসিপি’র কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের সেনা-র‌্যাব ও পুলিশ পাহারায় জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নেওয়া হয় নিরাপত্তার স্বার্থে। পরে সন্ধ্যার ৬টার দিকে সেনাবাহিনী সাজোয়া যানের মাধ্যমে এনসিপি নেতাদের গোপালগঞ্জ থেকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘটনার পর এনসিপি সারাদেশে ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা করে। এক পর্যায়ে শাহবাগসহ সারাদেশে ব্লক রেইড কর্মসূচি চলাকালে বিকেলে এনসিপি’র আহবায়ক নাহিদ ইসলাম ব্লকেড কর্মসূচি প্রত্যাহার করে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিলে ব্লকেড প্রত্যাহার হয়। বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংঘর্ষ ও সহিংসতায় নিহতরা হলেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার ভেড়ারবাজার এলাকার আজাদ তালুকদারের ছেলে ইমন তালুকদার (১৮), টুঙ্গিপাড়ার ইদ্রিস মোল­ার ছেলে সোহেল মোল­া (৩৫), থানার পাড়ার কামরুল কাজীর ছেলে রমজান কাজী (২২) এবং শহরের উদয়ন রোডের সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫)। তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
বুধবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডাঃ শেখ মোঃ নাবিলও এ তথ্য জানান।  
অন্যদিকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক জ্বীবিতেশ বিশ্বাস বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বেশ কয়েকজন হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মৃত ও পুলিশ-সাংবাদিকসহ ১২ জন আহত রয়েছেন।  
এদিন গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা চালায় ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এমনকি গোপালগঞ্জ কারাগারেও হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় দলটির ক্যাডাররা। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গোপালগঞ্জ শহর। এদিকে দু’পক্ষের সংঘর্ষ চলার মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান।
কারফিউ জারি : গোপালগঞ্জে আজ বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ২২ ঘণ্টার কারফিউ জারি করা হয়েছে। বুধবার রাত ৮টা থেকে এ কারফিউ শুরু হয়। বুধবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।  
এনসিপির পূর্ব ঘোষিত পদযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন ছিল গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে। এ নিয়ে সেখানে সার্বিক প্রস্তুতির পাশাপাশি সমাবেশ মঞ্চ তৈরি করা হয়। কিন্তু আগের দিন রাত থেকেই আওয়ামী লীগের লোকদের এনসিপির কর্মসূচি পণ্ড করতে অনলাইন-অফলাইনে সংগঠিত হতে দেখা যায়।
এর মধ্যে সকালে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে টহলরত পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের সমর্থকেরা।
এরপর সদর উপজেলার কংশুর এলাকায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) গাড়িবহরে হামলা ও ভাঙচুর করে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। দুপুরে তারা গোপালগঞ্জ শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর করে এবং ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে এনসিপির নেতা-কর্মীরা সেখানে যায় এবং সমাবেশ করেন। কিন্তু সমাবেশ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার পথে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আবার এনসিপির গাড়িবহরে হামলা চালায়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লোকেরা। তখন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। এ সময় অনেক সাংবাদিকও অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। পরে গোপালগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় বের হয় এনসিপির নেতাদের গাড়িবহর। রওয়ানা হয় খুলনার উদ্দেশ্যে।
এদিকে এ ঘটনায় গোপালগঞ্জ জেলা রিপোর্টার্স ফোরামের অফিসে হামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকেরা। এতে যমুনা টিভির সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মোজাম্মেল হোসেন মুন্না ও ডিবিসি টেলিভিশনের রিপোর্টার সুব্রত সাহা বাপিসহ অনেক সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তাদেরসহ এ ঘটনায় আহত অনেককে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে কতজন হতাহত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।  
প্রসঙ্গত, জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। মাসব্যাপী এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল গোপালগঞ্জে পদযাত্রা ছিল দলটির। গত মঙ্গলবার দলের ভেরিফায়েড ফেসবুকে এই কর্মসূচিকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ নাম দেওয়া হয়।
এই কর্মসূচি ঘিরে গোপালগঞ্জ সদরে বুধবার সকালে পুলিশের একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। কাছাকাছি সময়ে হামলা করা হয় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি বহরেও। এ দুই ঘটনায় স্থানীয় ছাত্রলীগ ও আ’লীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত বলে জানায় গোপালগঞ্জ পুলিশ।  
দুপুর ১টা ৩৫ মনিটের দিকে গোপালগঞ্জ শহরের পৌরপার্ক এলাকায় এনসিপির সমাবেশ মঞ্চে হামলা চালায় স্থানীয় আ’লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। তারা মঞ্চে থাকা সাউন্ড বক্স, মাইক ও চেয়ার ভাঙচুর করেন এবং উপস্থিত এনসিপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। এনসিপির নেতা-কর্মীরা পুলিশের সহায়তায় সেখান থেকে সরে যান।  
এ ঘটনার আধা ঘণ্টা পরে ওই সমাবেশ স্থলেই পুলিশী নিরাপত্তায় সমাবেশ করে এনসিপি। সেখানে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও আখতার হোসেনসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তৃতা করেন।  
সমাবেশ শেষ হওয়ার পর এনসিপির নেতারা যখন গাড়ি বহর নিয়ে মাদারীপুর রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন আবার ছাত্রলীগের কয়েকশ’ নেতা-কর্মী তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পুলিশও পিছু হটে। এনসিপির নেতা-কর্মীরা পালিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। হামলাকারীরা এনসিপির সমাবেশ মঞ্চ এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে চেয়ার-টেবিল ও আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেন। এতে শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামলাকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। গোপালগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় বিজিবি। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও বাড়তি জনবল নিয়োজিত করা হয়। বিকেলের দিকে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়তে দেখা গেছে। এরপর সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ একযোগে হামলাকারীদের সরাতে অভিযান শুরু করে।
এদিকে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গোপালগঞ্জে ২২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। বার্তায় বলা হয়, বুধবার রাত ৮টা থেকে পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে।