খুলনা | বুধবার | ২৩ জুলাই ২০২৫ | ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

‘শহিদ জিয়ার ভাতিজি হলেও সে পরিচয় কখনও দেননি’

‘আমার বাচ্চারা সব পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি কীভাবে সহ্য করি’ মৃত্যুর আগে স্বামীকে বলেন শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী

খবর প্রতিবেদন |
০১:৩৭ এ.এম | ২৩ জুলাই ২০২৫


মাহরিন চৌধুরী ছিলেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাতিজি। শহিদ জিয়ার খালাতো ভাইয়ের মেয়ে। ছিলেন অতি আদরের। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। একজন সাধারণ শিক্ষিকা হিসেবে মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজ ক্যাম্পাসে চাকুরি করেছেন। নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি রক্ষা করলেন অন্তত ২০ জন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে। নিভৃতে চলা এই মাহরিন চৌধুরী জিয়া পরিবারের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন, যা এখন প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যখন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন নিজে হাতে রান্না করা খাবার নিয়ে যেতেন বাসভবনে।
গত সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। ঘটনাস্থলে স্কুলের কো-অর্ডিনেটর মাহরিন চৌধুরী (৪২) দগ্ধ হন। দগ্ধ শরীর নিয়েই শিশুদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে স্বামী মনছুর হেলালের সঙ্গে কথা বলেন এই সাহসী শিক্ষিকা। 
মঙ্গলবার সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানিয়েছেন মনছুর হেলাল। তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা যেদিক দিয়ে বের হবে, ওখানে সরাসরি এসে বিমানটি ক্রাশ করছে, তারপরে এক্সপ্লোশন হয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। ঘটনার পর মাহরিন কিছু বাচ্চাকে বের করে নিয়ে আসে।’
আইসিউতে মাহরীনের শেষ কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আইসিইউতে আমি তাকে বললাম, তুমি কেন এ কাজ করতে গেলা? সে বললো, আমার বাচ্চারা আমার সামনে সব পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি এটা কীভাবে সহ্য করি। ও (মাহরীন) সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, কিছু বাচ্চা বের করছে, আরও কিছু বাচ্চা বের করার চেষ্টায় ছিল। ঠিক এমন সময় বিকট শব্দে আরেকটি বিস্ফোরণ হয়। আর তাতেই তার পুরো শরীর পুড়ে যায়।’
মনছুর হেলাল বলেন, ‘লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আমাকে আগে বললো, আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। হাত ধরা যায় না, সব পুড়ে শেষ। ও বললো, তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।’
বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিউতে তাঁর সঙ্গে মাহরীনের শেষ কথা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার সাথে তার আইসিইউতে যে কথা হইছে, আমি তাকে বললাম, তুমি কেন এ কাজ করতে গেলা? বলে আমার বাচ্চারা আমার সামনে সব পুইড়া মারা যাচ্ছে, আমি এটা কীভাবে সহ্য করি। ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে, কিছু বাচ্চা বের করছে, আরো কিছু বাচ্চা বের করার চেষ্টায় ছিল।’
ঠিক এমন সময় বিকট শব্দে আরো আরেকটি বিস্ফোরণ হয়। আর তাতেই ৪২ বছর বয়সী মাহরীনের পুরো শরীর পুড়ে যায় জানিয়ে মনছুর হেলাল বলেন, ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পুড়ে শেষ। শুধু বেঁচে ছিল একটু কথা বলতে পারছে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে বললো, আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। ভাই হাত ধরা যায় না, সব পুড়ে শেষ। ও বললো, তোমার সাথে আর দেখা হবে না।’
স্বামীর হাত ধরে মাহরীন তখন বলছিলেন, ‘আমার বাচ্চাদের দেখো।’ জবাবে মনছুর হেলাল বলেন, ‘ তোমার বাচ্চাদের এতিম করে গেলা!’
মাহরীন তখন বলেন, ‘কী করবো, ওরাও তো (মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা) আমার বাচ্চা, সবাই পুড়ে মারা যাচ্ছে আমি কীভাবে সহ্য করবো? রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সবাই সহযোগিতা করেছে, কিন্তু তাকে বাঁচাইতে পারলাম না। ..বলে আমার খুব খিদা লাগছে আমারে কিছু খাওয়াও, আমি ভাই তিন ফোঁটা পানি ছাড়া কিচ্ছু দিতে পারি নাই। ডাক্তার বলে ভাই শক্ত কিছু দিলেই বুকে আটকায়ে মারা যাবে। ভাই কী যে কষ্ট ভাই! ”
মাহরীনের ছোট ভাই মুনাফ মজিব চৌধুরী বোনের মৃত্যুর খবর দিয়ে ফেসবুক পোস্টে লেখেন, (ইন্নালিল­াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আমরাতো আল­াহর এবং আল­াহর কাছেই ফিরে যাবো)। মাহরীন আপু (মাহরীন চৌধুরী) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আমার বড় বোন। যিনি আমাকে মায়ের মতো করে বড় করেছেন। তিনি মাইলস্টোন স্কুলের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। ভবনে আগুন লাগার সময় তিনি সবার আগে নিজে বের হননি, বরং যতজন ছাত্র-ছাত্রীকে পারা যায়, বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে তাঁর শরীরের ১০০ শতাংশ অংশ পুড়ে যায়। আমার প্রিয় বোনের জন্য দোয়া করবেন দয়া করে। তিনি রেখে গেছেন তাঁর দুই ছেলে আমার দু’টি ভাগ্নে। আমরা এখনো হাসপাতালে থেকে তাঁর মরদেহ বুঝে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’
মাহরীন চৌধুরী নীলফামারীর জলঢাকার মৃত মহিতুর রহমান চৌধুরীর মেয়ে এবং জলঢাকা বগুলাগাড়ী স্কুল এ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি। নিজ গ্রামে শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন মাহরীন চৌধুরী। আজ সকাল থেকেই জেলার জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বগুলাগাড়ী গ্রামে তাঁকে দাফনের প্রস্তুতি শুরু হয়।
মাহরীন চৌধুরীর প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার বলেন, দুই ঈদ ও মাঝে মধ্যে গ্রামে আসতেন মাহরীন। এ সময় এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল এ্যান্ড কলেজের এ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।
নিহতের স্বামী মনছুর হেলাল বলেন, ‘ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বের হওয়ার সময় বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে। এ সময় মাহরীন সামান্য আঘাত পায়। কিন্তু ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ভেতরে আটকা পড়ে যায়। সে শিক্ষার্থী আটকা পড়ার বিষয়টি মোবাইলে আমাকে জানায় এবং তাদের উদ্ধারে ভেতরে ঢুকে পড়ে। শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টার পর মারা যায়।’
সোমবার (২১ জুলাই) রাতে মারা যান মাহরীন চৌধুরী। তার শরীরের ১০০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছিল বলে জানান আবাসিক সার্জন শাওন বিন রহমান।